হাওর: ভাটি বাংলার যুতসই মুখপত্র || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||


 হাওর: ভাটি বাংলার যুতসই মুখপত্র

বাপ্পা আজিজুল


হাওর। ত্রৈমাসিক ছোটকাগজ। ভাটি বাংলার সাহিত্যের কাগজ। আসিফ আল নূর সম্পাদিত, সেপ্টেম্বর ২০২১ এ প্রকাশিত। 'শিকড়ায়ন বাংলাদেশ' এর পক্ষ থেকে একদম টাটকাই হাতে পেয়েছি টোটকাটি। 'হাওর' এর মাধ্যমে আমরা পরিচিত হতে পারছি হাওরের মাটি, মানুষ, মননের সাথে। ঐতিহ্যগত পরম্পরার সাথে। 'হাওর' এর পয়লা এসংখ্যাটি নিভৃতচারী কবি আশুতোষ ভৌমিককে নিয়ে। 


আশুতোষ ভৌমিক। ভাটি বাংলার কবি। আপাদমস্তক কবি। নিভৃতচারী। যেন আরেক জীবনানন্দ। কবিতার গাঁথুনি ও চিত্রকল্পে তো বটেই এমনকি জীবদ্দশায় রেখে গেছেন জীবনানন্দের মতোই ৭ টি কাব্যকীর্তি। সত্তরের দশকে (১৯৭৪) কবিতার বইয়ের বউনি, এরপর দীর্ঘবিরতি দিয়ে কবির ২য় বই 'স্বপ্নরা স্বপ্ন দ্যাখে' ২০০৪ সালে। পরিচিতি লিখে দিয়েছেন বরেণ্য সমালোচক মান্নান সৈয়দ। তিনি লিখেছেন, "কবি আশুতোষ ভৌমিক দুটি মাত্র কবিতাগ্রন্থ লিখেও তাঁর আত্মসাক্ষর রাখতে পেরেছেন- এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তাঁর ২য় কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নরা স্বপ্ন দ্যাখে' পড়ে ভালো লেগেছিল বলেই সানন্দে পরিচিতি লিখে দিয়েছি: নিভৃতচারী কবি আশুতোষ ভৌমিক"। হাওরে প্রকাশিত কবি আশুতোষের কিছু কাব্যসুধা পান করা যাক-


"সেইসব দুপুরের আড়ালে প্রায়শই/ দাঁড়িয়ে থাকত কে? ক্ষুধা না প্রেম?/ প্রেম না ক্ষুধা? কে?/...... বাসকপাতার বনজুড়ে আমাদের নিরলস বাক্যব্যয়/ ঘামঝরা দুপুরগুলো রেখে দিয়ো/ গাংচিলহীনতা বুকে নিয়ে গোগ্রাসে/ গিলছে বিরহ নদী/রেখে দিয়ো..."(রেখে দিয়ো বালক)


"না না তেমন কোন দুঃখ নেই আমার/ভালো আছি/ আমার ভেতরে এখন/ তৃণদল- সুখেরা জন্ম নিচ্ছে/ এদের ছায়াভূমে কী সুন্দর উড়ছে দেখ/ হিমেল হাওয়ায় বিষণ্ণ আশু'র চুল... "(ভালো আছি)


"ধ্বংস ছাড়া হয় না সৃজন

মেঘ ছাড়া বৃষ্টি

যুদ্ধ ছাড়া হয় না স্বদেশ

প্রাণ ছাড়া কৃষ্টি।" (চৌপদী)


আশুতোষ ভৌমিক ৩ এপ্রিল, ২০২১ লোকান্তরিত হন। হাওর সূচনা সংখ্যা কবিকে নিবেদন করে তাঁর প্রতি সুবিচার করেছেন সম্পাদক তা বলা বাহুল্য। এসংখ্যাটিতে তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছেন কবি সোহরাব পাশা। এই তো কবির প্রতি কবির লিগ্যাসি। একদা কবি আশুতোষ ভৌমিকও কবি সুভাষ চন্দ্র রায়কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, 'এই হাত মৌতাত মৌবনে যৌবন/ এই হাত কংস বনমালী আজীবন'। 'ঈক্ষণ' সম্পাদক ও প্রকাশক বাবুল রেজা নস্টালজিক হয়েছেন দীর্ঘ সম্পর্কের জেরে। তার প্রবন্ধতে স্মরণ করেছেন বোহেমীয় আশুদা থেকে কবিতা কিংবা গল্প সংগ্রহের পেছনের গল্প ও কসরতের। ছন্নছাড়া আশুদার লাপাত্তা হওয়া আবার প্রেসে সহসা উদয় হয়ে লেখার বাতিকে রাত্রিযাপন। আশুতোষের শেষ কটি বই বাবুল রেজা'র 'ঈক্ষণ প্রকাশন' থেকে প্রকাশ হয়। সর্বশেষ কাজ চলছিল নির্বাচিত কবিতার। দেখে যেতে পারেননি কবি। এ এক আমৃত্যু আফসোস!  হাহাকার! মাশুক 'আশুদার খোঁজে' আশিক হয়ে খুঁজে হয়রান হয়েছেন লেখক অনিন্দ্য আসিফ। সেখানেও আমরা কবির চারিত জীবনের সাক্ষাত পাই। 'কবি আশুতোষ ভৌমিক ও তার কবিতাকলা' নিয়ে মূল্যায়নধর্মী গদ্য লিখেছেন আমিনুল ইসলাম সেলিম। তিনি কবির প্রথম দিকের কবিতাকে দেখছেন হাহাকার হিসেবে। তিনি জানাচ্ছেন, 'আশুতোষ ভৌমিক সারাজীবন খুব কম কথা বলেছেন, লিখেছেনও কম। কিন্তু ভেবেছেন অনেক বেশি'। আসাদ হোসেন তার নিবন্ধে কবিকে হাজির করেছেন একজন স্বপ্নালু কবি হিসেবে। হাওর সম্পাদক আসিফ-আল-নূর 'স্বয়ম্ভু কবি' বায়োএসে'তে বলছেন, "কৈশোরে আশুতোষ ভৌমিক একটি গানের দলে যুক্ত ছিলেন...অনেককে সঙ্গে নিয়ে একটি গীতিনাটকদলও বেঁধেছিলেন তিনি"। কৈশোরের আশুতোষ আরেকজন কবিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্বল্পায়ু কবি 'আবিদ আজাদ'। তাঁর 'কবিতার স্বপ্ন' বইয়ের শুরুতে নির্দ্বিধায় লিখেছেন,"লিখত আশু, পড়তাম আমি। আশু কবি, আমি পাঠক"। হবেই বা না কেন? মা যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আশুকে একটি কবিতা লেখার কাজ দিতেন। আর আশু শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে কবিতায় পারঙ্গম হতেন। 


কবি আশুতোষের পাশাপাশি হাওরের এসংখ্যায় ভাটি বাংলার বাউল ঐতিহ্য ও উত্তর আধুনিক কবিতা চর্চা বিষয়ক কিছু নিবন্ধ স্থান পেয়েছে। আছে বেশ কিছু চমৎকার কবিতাও। বাউলসাধক মামুদজানের উপর প্রিন্স রফিক খানের গবেষণা নিয়ে মন্তব্য ও পরামর্শ দিয়েছেন যতীন সরকার। ফকির বাউলদের দেহতত্ত্ব, চেতনা ও অধুনা গাঁজাপ্রীতি ও যৌনাচার নিয়ে যৌক্তিকতা বিচার করেছেন নজরুল ইসলাম সৃজন। ভাটি বাংলার আরেক সন্তান, নব্বইয়ের দশকে উত্তর আধুনিক কবিতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, সম্প্রতি প্রকাশিত 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: বাংলাদেশ যুগ (১৯৪৭-২০২০)' গ্রন্থে ড. উপল তালুকদারের ভাষায় নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের 'প্রবক্তা ও প্রধান পুরুষ', কবি ইশারফ হোসেনের 'লাল ফকিরের মাজার' কবিতাগ্রন্থ নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ নোট দিয়েছেন হাওর সম্পাদক, তাঁকে নিয়ে আরও লিখেছেন কবি অনন্ত সুজন। 'ঐতিহ্যের মাঠে অবাধ রাখাল' শিরোনামে অনন্ত সুজন লিখছেন, "তিনি নব্বইয়ের কবি। তার 'লাল ফকিরের মাজার' কাব্যগ্রন্থটি উপকরণে সমৃদ্ধ। ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় নান্দনিক প্রতীক। তিনি কাব্যবক্তা হিসেবে কতটা শৈল্পিকতাবাহী ও নিপুণ, তার যথাযথ সাক্ষ্য মেলে উক্ত গ্রন্থটির আভ্যন্তরীণ আয়োজনে।... ইশারফ হোসেন জীবনকে দেখেন 'এক কঠিন দায়িত্বশীলতায়' "। কবি মহিবুর রহিমের কবিতাগ্রন্থ 'হাওরবাংলা' নিয়ে চুম্বক আলোচনা করেছেন কবি প্রত্যয় জসীম। তিনি এই বইয়ের কবিতাগুলোকে  'বাংলা কবিতায় নতুন দরোজার সন্ধান' জ্ঞান করেছেন। 


এছাড়া কবি  সুনীল মাজি, কফিল আহমেদ, চাণক্য বাড়ৈ, ইশারফ হোসেন, মহিবুর রহিম, উপল হাসান, মেরাজ রাহীম, রুহুল কাদের প্রমুখের কবিতা শৈল্পিক এই সংখ্যাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাদাকালো পেপারব্যাকে নান্দনিক প্রচ্ছদে ৭২ পৃষ্ঠার 'হাওর' হয়ে উঠেছে ভাটি বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য, যুতসই মুখপত্র। চমক লাগানো হাওয়ার তোড়ে ভেসে না গিয়ে 'হাওর' শিল্পসত্তা নিয়ে বাংলাসাহিত্যে বহমান কাল ধরে বেঁচে থাকুক সেই প্রত্যাশা।

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.