সহিংসতা এবং আমরা।। বাপ্পা আজিজুল ।। মানসলোক।।
সহিংসতা এবং আমরা
বাপ্পা আজিজুল
বেশ কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের শিশু তুহিন কিংবা বুয়েট ছাত্র
আবরার বারবার আমাদের স্ক্রিনে ভেসে ওঠছে। প্রশ্ন ওঠছে এও কী সম্ভব?! কেন এ
সহিংসতা? কিসের এত রাগ কিংবা প্রতিশোধ
স্পৃহা? কেন এই বর্বরতা? কেন প্রাচীনতম নৃশংসতা? কেন এই পাশবিকতা? এ সহিংসতা কী
এবারই প্রথম? না। নুসরাত, তনু, খাদিজা, আবিদ আরও বিস্মৃত কত! সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে ব্যক্তি, দল, মত, জাতি,
ধর্ম নির্বিশেষে ভুরি ভুরি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এ সহিংসতা কোন কালেই
কারও জন্য কল্যাণকর হয়নি। মানবতার পতন হয়েছে প্রতিবার। কিন্তু এ সহিংসতা কি
অনিবার্য ছিল? কক্ষনো না। বরং চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যেত। সহিংসতার বিপরীতে অহিংসের
একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি রয়েছে তাও যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে।
সহিংসতা কি?
কোন ব্যক্তি অন্য কোন
ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষতি বা ধ্বংস সাধন করার উদ্দেশ্যে যে আচরণ করে বা প্রচেষ্টা চালায় তাকে সহিংসতা বলে।
যেমন- নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশুর প্রতি সহিংসতা, দলীয় উগ্রতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,
এথনিক ক্লিঞ্জিং, রাষ্ট্রীয় গণহত্যা ইত্যাদি।
মানুষ কেন সহিংস হয়?
পুরনো মতবাদ মতে,
"মানুষ জন্মগত সহিংস"। অধুনা তা অস্বীকার করে বলছে, "পুরোধা পরিবেশের
প্রভাব"। থমাস হবস- সতেরো শতকের দার্শনিক- বলছেন, "মানুষ প্রকৃতিগত প্রতিযোগী
ও পরশ্রীকাতর। সে সব সময় স্বার্থ সংরক্ষণ ও নিজ সুবিধার ব্যাপারে মনযোগী। তাই তাদের
তদারকির জন্য সরকার বা শাসকের প্রয়োজন পড়ে যেন অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে তারা নিঃশেষ হয়ে
না যায়"। এরপর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছেও আমরা কাছাকাছি ধারণাই পাই। প্রথমে ফ্রয়েড
প্রবর্তন করেন 'ইরোস'। অর্থাৎ সুখ-সমৃদ্ধির পেছনে মানুষের স্বত:প্রবণতা। এরপর প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের পরে আরোপ করেন 'থ্যানাটস'। অর্থাৎ মৃত্যু ও আত্মধ্বসের প্রতিও মানুষের
সহযাত্রা। যখনই তার সুখ-সমৃদ্ধির স্বার্থে আঘাত আসে, আরাম-আয়েশ, খায়েশের
ওপর কেউ বাগড়া দেয় তখনই সে সহিংস হয়ে ওঠে। হতে হয়। বাঁচার তাগিদে যেমন নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাকে খেতে
হয়। ঘুমোতে হয়।
বিজ্ঞানী কনরাড লরেঞ্জও সুর মিলিয়েছেন অনুরূপ। বলছেন, সহিংসতা অন্যান্য সকল প্রাণীর মতো মানুষের
সহজাত প্রবৃত্তি। তবে মানুষ একটি বিষয়ে পিছিয়ে কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত
বলা চলে। অন্য প্রাণীদের মতো তার কোন নিরাপত্তা সংকেত বা সেইফটি ডিভাইস নেই। পরস্পর বিবাদে বা সংঘর্ষের চূড়ান্ত পর্যায়ে দূর্বল প্রাণীরা নির্দিষ্ট আচরণ, সংকেত বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিরঙ্কুশ অধীনস্থ বা অসহায় প্রকাশ করে যেটি দেখে
প্রতিপক্ষ আশ্বস্ত হয়। সহিংস আচরণ থেকে নিবৃত্ত হয়। কিন্তু মানুষের এধরণের সেইফটি ডিভাইস না থাকায় প্রতিপক্ষ সহিংস থেকে সহিংসতর
হতে পারে"।
সহিংসতার একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হল হতাশা বা বঞ্চনা
সহিংসতার প্রসূতি। মানুষ যখন ক্রমাগত ও নিয়মিত শোষিত হয়, বঞ্চিত হয়,
দমিত হয়। স্বাধীনতা হারায়, বিচার পায় না, বাক-স্বাধীনতা খুইয়ে ফেলে তখন
সহিংস হয়। দেশে দেশে স্বাধীনতা, স্বাধিকারের লড়াইয়ে এজন্য সহিংস কর্মসূচি জনপ্রিয়
হয়। আবার স্বাধীন দেশে জন্ম দেয় সর্বহারা কিংবা উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী। এ সহিংস গোষ্ঠীর লক্ষ্য সব সময় ধনিক, বণিক বা রাজনৈতিক কেন্দ্রে নাও থাকতে
পারে। অনেক সময় লক্ষ্য হয় তাদের মতই সাধারণ কেউ বা খেটে খাওয়া মানুষ যাকে বলে বঁলির
পাঠা (Scapegoat)। এ তত্ত্বকে আরেকটু সরলীকরণ করে আরও বলা যায় মানুষ ক্রমাগত বিরক্তি কিংবা কষ্টের মধ্যে থাকলেও তার মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। সহিংস হতে পারে। যেমন- প্রচন্ড শব্দ, তীব্র দূর্গন্ধ, গরম ইত্যাদি।
উত্তেজনা ও স্নায়বিক উদ্দীপনার কারণে মানুষ অল্পতেই
ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সহিংস হতে পারে। যেমনটি হয় খেলার মাঠে
কিংবা মিছিলের মধ্যে থেকে। বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় জিনেদিন জিদানও অনেকটা এই পরিস্থিতির
শিকার।
সামাজিক শিক্ষণের মাধ্যমে সহিংসতা ছড়ায় বা অনেকে
আয়ত্ত করে। এতত্ত্বটি অধুনা সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিশেষ করে শিশুরা। পরিবারে সহিংস ব্যবহার দেখে তারা সবক নেয়। স্কুলে টিচার কিংবা বন্ধুদের দেখে সে শেখে। কেননা যে সহিংস হতে পারে প্রকৃতিগতভাবে সে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। শিশুরা দেখে ধমক দিলে কার্যোদ্ধার হয়। ক্যাম্পাসে জুনিয়রেরা শেখে কাউকে পেটালে রাতারাতি নেতা হওয়া যায়। কিংবা হিরোইজম উপভোগ করা যায়। এভাবে পরিজন-পরিবেশ আমাদের সহিংস করে তোলে। আবরার হত্যার পেছনে
এটিও অন্যতম নেয়ামক।
সামাজিক শিক্ষণের আরেকটি অংশ আসে টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সিনেমা, সিরিয়াল কিলার কিংবা গোয়েন্দা সিরিজ, সাইকো থ্রিলার
জাতীয় বই থেকে। ইদানিং যুক্ত হয়েছে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের ভাইরাল
ভিডিও, ছবি ও পোস্ট থেকেও। বাস্তবে কজন মানুষ অস্ত্র চোখে দেখে? কিন্তু সিনেমার কল্যাণে সব ধরণের অস্ত্রশস্ত্রের নাম সবার মুখস্থ। নায়ক-খলনায়ক সবাই সহিংস, ধর্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ কাস্টিং না হলে সিনেমা রিলিজ
পায় না। তারপরেও এজাতির রেপিস্ট, স্যাডিস্ট এর সংখ্যা নেহায়েত কম। তাই শিশু তুহিনকে হত্যা করে লিঙ্গকর্তন খুব অসম্ভব কিছু কি? পর্নো এক ধরণের
উগ্রতা,
সহিংসতা (aggression & violence), বিকৃত মানসিকতা (perversion)। এদেশে তার প্রচার, বিপণন বন্ধ হয়েছে কি?
সমাজতত্ত্বে আরেকটি বিষয় আলোচিত হয় সেটি হল দলীয় সিদ্ধান্ত
গ্রহণ (decision
making in groups)। যখন কয়েকজন মিলে গ্রুপে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন সামষ্টিক
সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগত পরামর্শের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও সহিংস হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে গ্রুপের সদস্যরা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি নিতে চায় কিন্তু
সামষ্টিক ফোরামে তা কয়েকগুণ বর্ধিত হয়। তখন পরিবেশের
চাহিদা, চাপ, চক্ষুলজ্জা কিংবা অনুসরণের নীতি মোতাবেক সদস্যরা তা মাথা পেতে নেয় বা অক্ষরে
অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। এভাবেই ছোটখাটো মারামারি কিংবা ভয় দেখানো আখেরে
ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে পরিণত হয়। সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া মাদকের অপব্যবহার সহিংসতার অন্যতম কারণ
হিসেবে বিবেচিত হয়। তরুণদের মধ্যে এটি বাড়ছে বলেই তারা বিভিন্নভাবে
সহিংস হয়ে ওঠছে বলা বাহুল্য।
সহিংসতা রোধে করণীয় কি?
# ব্যক্তি পর্যায়ে
- আত্মপর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ (আমি কতটুকু সহিংস? আমি অহিংস হওয়ার চেষ্টা করব।)
- আত্মমূল্যায়ন (পরিস্থিতি তৈরি হলে আমি কতটুকু আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারছি?)
- ইতিবাচক ফলাফল বা সফলতায় নিজেকে নিজেই পুরস্কৃত করা।
- রাগ কমানোর কলাকৌশল রপ্ত করা
- উত্তেজনা তৈরি হলে রিলাক্সেশন থেরাপি বা শিথিলায়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত
হওয়া
- উগ্র-সহিংস কন্টেন্টের বই, চলচ্চিত্র, ছবি, ভিডিও না দেখা। এক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়া এপের সেটিং পরিবর্তন করা এবং কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট
করা।
- অহিংসবাদীদের জীবন, কর্ম অধ্যয়ন করা
- সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো ও অনুশীলন করা।
#সামষ্টিক ভাবে
- সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করা। সমাজ উন্নয়নে সামাজিক
বৈষম্য,
বেকারত্ব, উগ্রতা, সহিংসতা, মাদক, আত্মহত্যা, অপমৃত্যু হ্রাস পায়। নারীর ক্ষমতায়ন হয়। সংখ্যালঘু, পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার
ফিরে পায়।
- রাষ্ট্রকে সার্বভৌম হতে হবে। আইনের শাসন, বাক-স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা সহিংসতা শিক্ষণের
সহায়ক মাধ্যম হবে না।
No comments