স্বর্গের ছাড়পত্র।। খন্দকার করিম।। মানসলোক ডট কম।।

স্বর্গের ছাড়পত্র।। মানসলোক ডট কম।। 

খন্দকার করিম 



“সবুজ সুধার ধারায়, প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়,

বামে রাখ ভয়ঙ্করী, বন্যা মরণ-ঢালা।”


চীনের হলুদ (yellow) নদীকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখলে একটুও ভুল হতো না। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, “You cannot live with her, you cannot live without her.” কথাটি যেন হলুদ নদীকে ভেবেই লেখা। চীনের হলুদ নদীর সাথে কি নারীর তুলনা করা যায়? প্রায় দশ হাজার বছর আগে চীনের হলুদ (yellow) নদী এবং ইয়াংসি (Yangtze) নদীর তীরে মানুষ ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে। এই দুটি নদীর পাড়ে সহজেই ভুট্টা এবং ধান চাষ করা যেত। কিন্তু বেপরোয়া হলুদ নদীর মতিগতির কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না, বারবার দিক পরিবর্তন করে, বন্যার জলে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে দেয়, অসংখ্য মানুষের মরন ডেকে আনে। ওর সাথে বাস করা কঠিন কিন্তু ওকে ছাড়া বেঁচে থাকারও কোনো উপায় নেই।


সে যুগে সবাই ছিল কৃষক। তবে ইউকে (Yu) একজন প্রকৌশলী বলা চলে। প্রতিদিন হলুদ নদীর পাড়ে ইউ কয়েক কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করতেন এবং ভাবতেন কী করে এই নদীকে বশে আনা যায়। ইউয়ের বাড়ি নদীর পাড়ে, বাড়িতে তাঁর স্ত্রীর কোলে নতুন শিশু, যাত্রাপথে প্রতিদিন ইউ কয়েকবার নিজের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন, কিন্তু একবারও সেখানে থামেন নি, স্ত্রী-সন্তানের কথা মনেও পড়ে নি। হলুদ নদী কি ইউয়ের বৌয়ের সতীন? এমন স্বামীকে হয়তো নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারা উচিৎ, কিন্তু ইউয়ের বউ তেমন কিছুই করেন নি, বরং স্বামীর জন্যে বানিয়ে রাখতেন উপাদেয় সব খাবার। খাল কেটে নদীর পানি অনেক দূরে নিয়ে যেয়ে ধান এবং ভুট্টার ক্ষেতে দিলে কেমন হয়? হয়তো এতে দুরন্ত হলুদ নদী কিছুটা শান্ত হবে, ওর অতিরিক্ত পানি যাবে কমে, সেই সাথে ফসলের ক্ষেত পাবে পর্যাপ্ত পরিমান জল। এমন কথা এই দেশে আগে কেউ ভাবে নি! কৃষকদের নিয়ে ইউ লেগে গেলেন খাল খননের কাজে। সেবারে খুব ভালো ফসল হলো। আসেপাশে ছড়িয়ে গেল এই নতুন খবর। সবাই খাল কাটা শুরু করলো, বন্যার পানি খানিকটা বশে আসলো, সেই সাথে পাওয়া গেল ভালো ফসল। সবাই খুশি। শেষে ইউকে দেশের রাজা ঘোষণা করা হলো। চীনদেশে রাজাকে বলে সম্রাট এবং সাম্রাজ্যকে বলে ডাইনাস্টি (dynasty), খৃষ্টপূর্ব ২১০০ সালে ইউ প্রতিষ্ঠিত করলেন চীনের প্রথম ডাইনাস্টি, শ্যা (Xia) ডাইনাস্টি। এই ডাইনাস্টি ৫০০ বছর রাজত্ব করে। এর পরে আরো অনেক ডাইনাস্টি এসেছে, স্যাঙ (Shang), ঝাও (Zhao), মিং (Ming), চীন (Qin), এবং হান (Han) ডাইনাস্টি। 


রাজা বা সম্রাট হতে গেলে কি ধরণের গুনাবলীর প্রয়োজন? সে আমলের সক্রেটিস, কনফুসিয়াস এক কথা বলেছেন, মধ্যযুগের ম্যাকিয়াভেলি (Nicholas Machiavelli) বলেছেন একেবারে উল্টো কথা। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে রাজাকে জ্ঞানী এবং দার্শনিক (philosopher king) হতে হবে। ইতালির দার্শনিক এবং ডিপ্লোম্যাট ম্যাকিয়াভেলীর মতে "ছলে, বলে, কৌশলে,” রাজ্য শাসন করতে হবে। প্রয়োজনে রাজাকে হতে হবে ধূর্ত, কঠোর, নৃশংস। অশুভ পন্থা, দৌরাত্ম্য, স্বৈরশাসন যদি প্রজাদের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনে তবে রাজাকে তাই করতে হবে। চীন দেশে প্রচলিত ছিল ভিন্ন কথা, রাজা হতে হলে রাজাকে পেতে হবে স্বর্গের ছাড়পত্র। কেমন করে স্বর্গের ছাড়পত্র পাওয়া যায়? একজন সচ্চরিত্র, নীতিপরায়ণ, দয়ালু রাজা এমন ছাড়পত্র পেতে পারেন। মৃত্যুর পরে তাঁর বংশধরও এই ছাড়পত্র পাবে, তবে ভবিষ্যতে কেউ নীতিভ্রষ্ট হলে স্বর্গ এই ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নিবে। কেমন করে তা বোঝা যাবে? দেশে প্লাবন, ভূমিকম্প, মহামারী, দিয়ে স্বর্গ তা জানিয়ে দিবে। চীনের রাজনীতি যুগযুগ ধরে স্বর্গের ছাড়পত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে মরছে। 


খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে চীনারা সিল্কের কাপড় বানানো শিখে যায়। এর পরে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত সিল্ক বানানো পৃথিবীর আর সব সভ্যতার কাছে রহস্যই থেকে যায়। চীন থেকে ভারত হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত যে দুর্গম রাস্তা দিয়ে বণিকরা আসা যাওয়া করতো তার নাম দেয়া হয় সিল্ক রোড। খৃষ্টপূর্ব ৬০০ সালে চীনের সিল্ক জার্মানির হাটে বিক্রি হতো। সে আমলে গ্রিস বাদে ইউরোপের আর সব দেশকে অসভ্য বলা যেতে পারে। এখন জার্মানিতে তৈরী মটরগাড়ি চীন বা ভারতে যেমন দুর্লভ মনে করা হয়, সে আমলে চীনের তৈরী সিল্কের কাপড় ইউরোপে তেমনি দুর্লভ মনে করা হতো। সে সময় সমগ্র চীন শতাধিক অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিল, এবং এদের মধ্যে যুদ্ধ, বিবাদ লেগেই থাকতো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সালে টিন, সীসা, এবং তামা মিশিয়ে চীনারা ব্রোঞ্জ তৈরী করা শিখে যায়। ব্রোঞ্জের তৈরী চাকা দিয়ে যুদ্ধের রথ এবং অস্ত্র তৈরী হলো। সেই অস্ত্র এবং ঘোড়ায় টানা রথ নিয়ে যুদ্ধে করে শ্যা ডাইনাস্টিকে পরাজিত করে সাঙ ডাইনাস্টির প্রতিষ্ঠা হয়। ৬০০ বছর পরে সাঙ ডাইনাস্তিকে পরাজিত করে ঝাও ডাইনাস্টি আসে। সাঙ ডাইনাস্টির সম্রাট কেন হেরে গেলেন? কারণ, সে আমলের চীনাদের মতে, তিনি স্বর্গের ছাড়পত্র হারিয়ে ফেলেছিলেন। কেন তিনি স্বর্গের ছাড়পত্র হারালেন? কারণ, তিনি নীতিভ্রষ্ট হয়ে মদ এবং নারী নিয়ে সময় কাটাতেন, সাধারণ প্রজাদের উপরে অত্যাচার করতেন।


তাম্র এবং ব্রোঞ্জ যুগের পরে আসে লৌহ যুগ। লোহাকে গলাতে ১৫৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লাগে, চীন দেশে প্রথম এমন উত্তপ্ত চুলা তৈরী করা সম্ভব হয়। এরপরে শুরু হয় একধরণের চৈনিক শিল্প বিপ্লব। অনেক শহরে কারখানা গড়ে উঠে। ব্যাপক হারে লোহার সরঞ্জাম, এবং অস্ত্র তৈরী শুরু হয়। কোদাল, লাঙ্গল, হাড়িপাতিল, খুন্তি, কড়াই, দা, কুঠার, চাকু, বল্লম।


ঝাও ডাইনাস্টি প্রায় ৮০০ বছর টিকে ছিল। চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াসের জন্ম এবং মৃত্যু (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১-৪৭৯) এই আমলে হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে গ্রীসে জন্মেছিলেন সক্রেটিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯); ভারতে গৌতম বুদ্ধ (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩-৪৮৩); এবং মহাভিরা (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০-৪৬৮)। ইহুদিদের ধর্মগ্রহ ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা তখনো শেষ হয় নি। তবে এর অনেক আগেই ভারতে বেদ লেখা হয়ে গেছে। আরো দুই শ বছর পরে দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট গ্রিস থেকে বের হয়ে যুদ্ধ করতে করতে ভারতে এসে পৌঁছাবেন। "যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে তোমার জন্যে কি নিয়ে আনবো?" আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট তাঁর গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। "কিছু না, যদি পারো তবে আমার জন্যে শুধু এক কপি বেদ নিয়ে এসো," এরিস্টটল বলেছিলেন।


রাজার সাথে প্রজার এবং একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সম্পর্ক কেমন হতে হবে তা নিয়ে দার্শনিকরা যুগেযুগে তর্ক করেছেন, ধর্মগ্রন্থে আছে অনেক উপদেশ এবং নির্দেশ। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসও এসব নিয়ে অনেক ভেবেছেন। “Government of the people, by the people, for the people,” এবং “Do unto others what you wish done to yourself,” জাতীয় কথা কনফুসিয়াস সেই আমলেই চালু করেছিলেন। পারিবারিক স্নেহবন্ধনকে কনফুসিয়াস খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন, মানুষের সাথে মানুষের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ককে তিনি সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন। রাজকার্য কেন শুধুই জমিদার, ল্যান্ডলর্ড, রাজবংশ, এবং নোবলম্যানদের দখলে থাকবে? কনফুসিয়াসের আদর্শ অনুসারে ঝাও ডাইনাস্টিতে প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রচলন হয়। এই পরীক্ষায় পাস করা সহজ ছিল না, তবে কেউ পাস করলে রাতারাতি তার কপাল খুলে যেতো। রাজক্ষমতার কিছু ভাগ এই প্রথম সাধারণ মানুষ পেয়েছিল। একটা মুশকিল কিন্তু থেকেই গেল। রাজক্ষমতার স্বাদ পেলে সাধারণ মানুষ অতি দ্রুত তার পুরানো পরিচয় ভুলে যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে; পোশাক, আচরণ সব বদলে যায়। এই সমস্যার সমাধান সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশেই হতে পারে। সে আমলে চীন দেশে শুধু ছেলেরাই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতো। নারীদের সমান অধিকারের দিল্লি আরো অনেক দূরে।


No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.