ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||

ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা 

বাপ্পা আজিজুল



বুদ্ধিমত্তা কী?

জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার আলোকে কোন বিষয়ে বিবেচনা, কর্মতৎপরতা ও খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতাকে বুদ্ধিমত্তা গণ্য করা হয়। 


বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ কি কি? 

বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের তালিকায় রয়েছে-

১. যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া (reasoning)

২. পরিকল্পনা প্রণয়ন (Planning)

৩. ভাবগত চিন্তার ক্ষমতা (Abstract thinking)

৪. পর্যালোচনামূলক চিন্তা (critical thinking)

৫. সমস্যা সমাধান (problem solving)

৬. বিচারবোধ (judgement)

৭.  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণ  (academic learning)

৮. অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা অর্জন (learning from  experience) [আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েশন, ২০২২]


বুদ্ধিমত্তা যাচাই ও ব্যবহারের ক্ষেত্র (domain):

১. জ্ঞানগত 

২. ব্যবহারিক

৩. আর্থ-সামাজিক

৪. আধ্যাত্মিক 


আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা (spiritual intelligence) কাকে বলে?

ফয়েজ এম. (১৯৯৬) এর মতে, আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা এমন একটি ক্ষমতা যা জীবনকে পরিচালিত করে। ইম্মন (২০০০) বলেছেন, আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তায় এমন শক্তি রয়েছে যা মানুষের আত্মিক ও ধর্মীয় সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারে। 


আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্র (Domain): 

১. রুহ

২. কলব

৩. নফস

৪. আকল

৫. তাওহিদ 

৬. ইবাদত

৭. আদব ও নৈতিক চরিত্র


বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে ইসলাম চর্চা: 

ইসলাম স্বভাবধর্ম। মানুষের ফিতরাতকে ইসলাম গুরুত্ব দেয়। নবি কারিম সা. মানুষের ফিতরাতকে উপলব্ধি করেছেন এবং সেটির আবেদনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সত্য অনুধাবনের জ্ঞান ফিতরাতের মধ্যে অন্তর্নিহিত। 

প্রত্যেক নবি-রাসুল (আলাইহিমুস সালাম) তাঁর কওমের মানুষকে তাই সর্বপ্রথম স্রষ্টাকে জানার আহ্বান করেছেন। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন ও যুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা। প্রত্যেক হৃদয়ই তার স্রষ্টাকে জানে এবং তাঁর অস্তিস্ত্বকে স্বীকার করে। প্রত্যেক মানুষই ফিতরাতের ওপর দুনিয়াতে আসে, এক্ষেত্রে অন্য কিছু ঘটলেই কেবল সেখানে পর্দা পরে। সুতরাং কারও সামনে যখন সত্য তুলে ধরা হয় সে তাই স্মরণ করে বা মেনে নেয় যা তার ভেতরে সুপ্ত ছিল, এর নামই ফিতরাত। এটি নিশ্চিত যে, সকল জ্ঞানের পূর্বশর্ত হল যুক্তি। এবং জ্ঞানই সকল সৎ গুণ ও উত্তম জীবনের পূর্বশর্ত। যুক্তির সাহায্যে আমরা জ্ঞান ও গুণাবলী অর্জন করি তথাপি এটিই পর্যাপ্ত নয়। এটি আমাদের আত্মার একটি কার্যক্ষমতা মাত্র। যেমন বলা যায় যুক্তি আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তির মতোই একটি শক্তি ও ক্ষমতা। এটি কেবল তখনই কাজ করে যখন ঈমান ও কুরআনের আলোকরশ্মি তাতে নিপতিত হয়। যেমন কোন বস্তু, সূর্য কিংবা আগুন থেকে আলোকরশ্মি আমাদের চোখে পৌঁছালে আমরা তা দেখতে পারি। যুক্তি ছাড়া যুক্তি নিজেই অচল।

নবি-রাসুলেরা (আলাইহিমুস সালাম) যে জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন তা নিছক যুক্তিসর্বস্ব ছিল না। এবং তারা এমন কিছু কখনও নিয়ে আসেননি যা যুক্তি বহির্ভূত (ইবনে তাইমিয়া, মাজমু ফাতওয়া)। 


জ্ঞানের সর্বসম্মত উৎস ৩টি। ১. আকল বা যুক্তি বা প্রজ্ঞা ২. নাকল বা ওহির জ্ঞান (কুর'আন, হাদিস) ৩. কাশফ বা স্বজ্ঞা। ইসলামের ইতিহাসে কেবল যুক্তিকে প্রাধান্য বা পর্যাপ্ত মনে করার কারণে মুতাযিলা সম্প্রদায়, নাকলকে প্রাধান্য দেয়ায় মুতাকাল্লিমুন বা কালামশাস্ত্রবাদীরা, কাশফকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য সুফি সম্প্রদায়ের অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। মধ্যমপন্থীদের কাজ হল উপর্যুক্ত ৩টি উৎসের জ্ঞানের সমন্বয় করা। ইসলামে যুক্তি ও দর্শন চর্চার সুবিদিত ঐতিহ্য আছে। যুগের মুজাদ্দিদেরা ওহি, যুক্তি ও দর্শনের আলোকে সমাজের ভ্রান্তিগুলো পর্যালোচনা ও সংশোধন করেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম গাজালি, ইমাম তাইমিয়া প্রমুখ ছিলেন অগ্রগণ্য। ইসলাম চরমপন্থা নয় বরং মধ্যমপন্থী, উদারনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্য কুর'আনের ঘোষণা 'কুনু রব্বানিয়্যিন' বা 'রব্বানী হয়ে যাও'। রব্বানীর সংজ্ঞার মধ্যে পুনঃপুন ফিকহ, দর্শন, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক গভীর জ্ঞান অর্জনের উল্লেখ করা হয়েছে। মুজাহিদ র. ব্যাখ্যা করেছেন, পাদ্রিরা হল সাধারণ জ্ঞানী। রব্বানীরা হলেন সাধারণ জ্ঞান, ফিকহ, দর্শনশাস্ত্রে পারদর্শী। রাজনৈতিক এবং জাতীয় জীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা দক্ষ নেতা হিসেবে মানুষের ইহকাল ও পরকালের সমস্ত কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন (তাফসিরে তাবারী)। 


রাসুল সা. এর মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া আরবের রব্বানী বিপ্লবের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আল্লামা আজাদ সুবহানী বলেন- হীনতাবোধ ও সংকীর্ণ ধারণা বিলুপ্তির যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি প্রয়োজন ছিল উচ্চ মর্যাদাবোধ ও উচ্চ ধারণা সৃষ্টির। অন্যকথায়, কুসংস্কার উচ্ছেদ করার প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার। তবে নফসানি যুক্তির নয়, কারণ তা অপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর হয়ে থাকে। নফসানি যুক্তি কুসংস্কারের সামান্য উপরের বস্তু মাত্র; এটি পরমার্থ হতে মানুষকে তো দূরে রাখেই, এমনকি অনেক সময় পরমার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই রব্বানী যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠারই প্রয়োজন ছিল- যা অন্ধ কুসংস্কার হতে অধিকতর দূরের বস্তু, যা ঠিক পরমার্থের দিকেই মানুষকে নিয়ে যায় এবং এমনকি অনেক সময় পরমাতের কোলেও পৌঁছে দেয়।... এদিক দিয়ে বিচার করলে অন্ধ ধারণার নাম শির্ক এবং যুক্তিমূলক ধারণার নামই হল তাওহীদ।... উপর্যুক্ত প্রয়োজনের দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল দর্শনের প্রতি মনোযোগ দান করা। ধর্মের পরেই দর্শন মানুষের জীবনে অধিক প্রভাবশালী ধারণা ও ব্যবস্থা। দর্শনও অবাস্তব কল্পনার শিকারে পরিণত এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সম্পর্ক রহিত হয়ে পড়তে পারে।... সুতরাং দর্শনকেও অবাস্তব কল্পনার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থেকে যুক্তিবৃত্তির উজ্জ্বল আলোকে আনয়ন করা ছিল আরবের রব্বানী বিপ্লবের ২য় প্রয়োজনীয় কর্তব্য।... এরপর প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তির নিষ্ক্রিয়তা ও বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ এবং বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও তাতে চিন্তাশক্তির সৃষ্টি। কিন্তু তা 'রব্বানী' চর্চা হবে, নফসানি চর্চা নয় এবং চিন্তাও হবে রব্বানী চিন্তা, নফসানি চিন্তা নয়। উপরের ক্ষেত্রগুলোই অর্থাৎ ধর্ম, দর্শন, তমুদ্দুন-তাহজিবই হচ্ছে এই প্রয়োজনের প্রয়োগস্থল (বিপ্লবী নবি, ১৯৬৮)। 


সমকালের জাহিলিয়াতকে মোকাবেলা ও সমাজ সংশোধনের জন্য মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার কোন বিকল্প নেই। অথচ সামগ্রিকভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের দিকে তাকালে তাদের ভাবলেশহীন বলেই মনে হয়। যারা টুকটাক সোচ্চার, তারাও শ্লোগান সর্বস্ব অথবা কেবল নাকলি জ্ঞানের ফতোয়াবাজিতে ব্যস্ত। যুগের চাহিদা ও চিন্তাপ্রবাহ অনুধাবনে তারা অপারগ। অনুধাবন (understanding), অন্তর্দৃষ্টি (insight), বিচারক্ষমতা (judgement) বুদ্ধিবৃত্তির মজ্জা। এই মজ্জাগত লঘুতার দরুণ তারা সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন, কর্মনীতি প্রণয়ন ও অগ্রাধিকার তালিকা তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উত্তর ন্যানোটেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষতার যুগে বাস করছি। প্রযুক্তির বহুবিধ কল্যাণের পাশাপাশি অনেক অনেক অভিশাপ আমাদের জীবন ও সমাজকে ঘুণে পোকার মতো ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, স্ক্রিন, পর্ন আসক্তি প্রভৃতি এবং সেসব থেকে উদ্ভূত সামাজিক, যৌন বিকৃতি, আবেগীয় বিকৃতি, নিঃসঙ্গতা, আত্মহনন আমাদের প্রধানতম সামষ্টিক সমস্যা। ১৯৯৫ সালের পরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে বলা হয় i-gen বা gen-z. এই প্রজন্ম ঘরমুখো, অন্তর্মুখী, প্রযুক্তি নির্ভর/আসক্ত, নি:সঙ্গ, অসামাজিক, আবেগীয় ব্যাপারে অসহনশীল ইত্যাদি। তাদেরকে সামাজিক, পরার্থপর, উৎপাদনমুখী, সহনীয় করার জন্য যথাযথ কর্মসূচি নেয়া অবশ্যই অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত। উপনিবেশ উত্তর বাংলাদেশের বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও যথার্থ বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারিনি আমরা। উপনিবেশ আমাদের নৈতিকভাবে দেউলিয়া করে গেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি সেক্টরে করেছে বিইসলামিকরণ। তাই ইসলামিকরণই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর ঔপনিবেশিক পদক্ষেপ। কিন্তু এই ব্যাপারে অন্য অনেক মুসলিম দেশ থেকেই আমরা পিছিয়ে। ইউরোপীয় ১ম শিল্প বিপ্লব, জ্ঞানের রেনেসাঁ, এরপর পর্যায়ক্রমে আমদানি হওয়া উপনিবেশবাদ, প্রাচ্যবাদ, আধুনিকতাবাদ জড় ও বস্তুবাদী যুক্তি-দর্শনের মাধ্যমে আমাদের মন-মগজকে আচ্ছন্ন ও দূষিত করে তুলেছে। ফলে নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে ওঠেছে আরাধ্য। এই অবক্ষয়ী আধুনিকতার জাহেলিয়াত থেকে জাতিকে মুক্তির জন্য ধর্মাশ্রয়ী উত্তর আধুনিকতার অভিমুখ আমাদের অজানা। বর্তমান সময়কে বলা হয় উত্তর-সত্য কাল (post truth era)। ২০১৬ সালে আসলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে অবলীলায় যে মিথ্যা ভাষণ দেন, সেই সময়কে উত্তর-সত্য যুগের সূচনা ধরে শব্দটি প্রচলিত করেছে অক্সফোর্ড ডিকশনারি।  এখন সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা বৈশ্বিকভাবে সত্যের কোন লেশ নেই। মিথ্যাই সমাজে অলংকৃত, চমৎকৃত, আধিক্য, প্রতিষ্ঠিত। আমরা নাস্তিক্যবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার কারণে প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রচার-প্রোপাগান্ডা, ইতিহাস ও বয়ানের (narrative) শিকার। তার বিপরীতে শুদ্ধ, সঠিক, নির্মোহ ইতিহাস ও বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে মুসলিমরা বরাবর পিছিয়ে। ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কেবল কিতাবি নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদকেও রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও চর্চার মাধ্যমে উৎখাত করতে হবে। এই ফ্যাসিবাদী সময় ও সমাজে হকের উপদেশ দিতে যাওয়া নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এতে বৈষয়িক নানাবিধ ক্ষতি হওয়ার শংকাও প্রবল। কিন্তু আপনার আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা (spiritual intelligence) যদি সঠিকভাবে গড়ে ওঠে ও চর্চিত হয় তবে আপনি সবর ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে উতরিয়ে যেতে পারবেন। 

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.