বাংলাদেশের দরিদ্রতা নিরসনে প্রস্তাবনা || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||
বাংলাদেশের দরিদ্রতা নিরসনে প্রস্তাবনা
বাপ্পা আজিজুল
ভূমিকা:
৩য় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ (যদিও মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়) এবং প্রাক্তন উপনিবেশ বাংলাদেশ ও দরিদ্রতা এক হরিহর আত্মা। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে ৩১.৫% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে এবং পরবর্তী ১০ বছরে এই হার ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০০৫ সালে এই হার ছিল ৪০.৪%। সেসময়ের আরেকটি জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে ২০% উচ্চবিত্তের কাছে কুক্ষিগত আছে ৪২.৮ ভাগ সম্পদ (WDI, 2000)। ২০২৩ সালের একটি বেসরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ড. আবুল বারকাত বলেছেন, বস্তিবাসী মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নগর দরিদ্রতাকে নির্ধারণ করতে হবে। বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের খানা জরিপে দেখা যায়, বস্তি ও নিম্নআয়ের বাসিন্দাদের কমপক্ষে ৮২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এখান থেকে নগর দারিদ্র্যের হিসাব করা সম্ভব। নগর জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বস্তি ও নিম্ন আয়ের খানা। যাদের ৮২ শতাংশ দরিদ্র। এই হিসাবে নগরের দরিদ্রতার হার ৪১ নগর দারিদ্র্যতা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। (দৈনিক ইত্তেফাক, অনলাইন সংস্করণ, ২৮.৮.২৩)। সুতরাং দরিদ্রতা নিরসনে রাষ্ট্র, সরকার, বেসরকারি উদ্যোগসমূহ ব্যর্থ হয়েছে সেকথা বলাই যায়।
দরিদ্রতা কাকে বলে?
দরিদ্রতার তাত্ত্বিক সংজ্ঞার চেয়ে পরিমাপগত সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে। প্রতিদিন জীবনধারণের জন্য ২১২২ ক্যালরি খাদ্য আও ৫৮ গ্রাম আমিষ ক্রয়ে অক্ষম জনগোষ্ঠীকে ধরা হয়। আর যে জনগোষ্ঠী ১৮০৫ ক্যালরি জোটাতে অক্ষম তারা চরম দরিদ্র।
বাংলাদেশে দরিদ্রতার কারণ:
১. দূর্নীতি ও অসততা; বর্তমানে দুর্নীতিতে বিশ্বে ১০ম। পয়েন্ট ২৪ (প্রথম আলো, অন সংস্ক, ৩০.১.২৪)।
২. মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগে স্থবিরতা; ২০২৩ সালের গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৪৮ শতাংশ (বিডিনিউজ২৪.কম, ১৪.১.২৪)
৩. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও শোষণমূলক সমাজ
৪. সম্পদের অসম বন্টন ও বৈষম্য
৫. সম্পদ আহরণ ও যথাযথ ব্যবহার না হওয়া
৬. বেকারত্ব
৭. সম্পদের মালিকানার ব্যাপারে ভুল ধারণা (সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা)
৮. অদক্ষ ও অসৎ নেতৃত্ব
৯. রাজনৈতিক স্থবিরতা, নিরাপত্তার অভাব
১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন
১১. দুর্বল মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা
১২. কারিগরি জ্ঞানের অভাব
১৩. অনগ্রসর কৃষি ও শিল্প
১৪. এনজিওদের শোষণ
১৫. সরকারের ব্যর্থতা
বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রস্তাবিত কৌশল:
যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলাম সাংবিধানিক স্বীকৃত এবং উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনার অংশ হিসেবে এদেশে প্রতিটি সেক্টর ইসলামাইজেশন হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত, সেহেতু দরিদ্রতা নিরসনে অর্থনীতির ইসলামিকরণ ও বাস্তবায়নই সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে সারাবিশ্বেই হালাল ইকোনমির বাজার, চাহিদা ও কলেবর বাড়ছে, তাই বাংলাদেশ হালাল ইকোনমির একটি পটেনশিয়াল ও এমার্জিং দেশ হতে পারে। ইসলাম দরিদ্রতাকে পছন্দ করে না এবং সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চায়। কেননা, রাসুল সা. বলেছেন, 'দরিদ্রতা কুফরের দিকে ধাবিত করে' (বুখারি ও মুসলিম)। ইসলাম তাই এব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৌশলগুলোকে মোটাদাগে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়-
১. ইতিবাচক পদক্ষেপ
২. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
৩. সংশোধনমূলক কার্যক্রম
৪. উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ
নিচে সংক্ষেপে এগুলো তুলে ধরা হল-
• ইতিবাচক পদক্ষেপ
১. আয়-উপার্জন বৃদ্ধি
২. মূল্যস্ফীতি হ্রাসকরণ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি
৩. সম্পদের সুষম বন্টন
৪. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধি (বিশেষ গুরুত্ব পাবে)
৫. বৈষম্যকে খেদিয়ে সমান সুযোগ প্রদান
৬. ব্যাবসায়ে উদ্বুদ্ধকরণ, আমদানি-রফতানি, ঋণের প্রণোদনা
• প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. মালিকানা নিয়ন্ত্রণ (সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা -এই দর্শনটির ব্যাপক চর্চা প্রয়োজন)
২. পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রত্যাখান
৩. অসততা ও দূর্নীতি প্রতিরোধ (এর মধ্যে চোরাচালান, কালোবাজারি, সিন্ডিকেট, সুদ, ঘুষ, কমিশন, চাঁদাবাজি, ফটকাবাজি, প্রতারণা, বিদেশে অর্থপাচার, কালোটাকাসহ সব অন্তর্ভুক্ত হবে)
• সংশোধনমূলক কার্যক্রম
১. সম্পদ হস্তান্তরের বিশেষ মেকানিজম বাস্তবায়ন
২. বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও নিয়ন্ত্রণ এবং সংস্কার
৩. রাষ্ট্রের দায়িত্ব
সম্পদ হস্তান্তরের বিশেষ মেকানিজম বাস্তবায়ন
১. ফরজ
- যাকাত; ২০২৪ সালে ৭১০০০ কোটি টাকা যাকাত উত্তোলিত হয়েছে (Fintech, 2024)।
- উশর (কৃষিকে প্রাধান্য দিলে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে)
- খুমুস (রিকাজ বা খনিজ দ্রব্য, গুপ্তধনের ১/৫ অংশ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য খনিজের আয়ের ১/৫ কত হতে পারে তা অনির্ণীত)
- কাফফারা
- ফিদিয়া
- মোহর
২. ওয়াজিব
- ফিতরা
- নাফাকাহ
- কুরবানি; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশুর চামড়া বাণিজ্য ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ গরু ও ৩০ লাখ ছাগল কুরবানি করা হয়। প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ২০০০/- ও ছাগলের চামড়া গড়ে ১০০/- হলে প্রতিবছর চামড়ার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে ৬২৬ কোটি টাকা।
- আকিকা
- মানত-নজর
৩. নফল
- সাদাকাতুন নাফিলা (যে কোন নফল সদাকা, হাদিয়া)
- হেবা
- ওয়াকফ
- ওসিয়ত (১/৩ এর বেশি নয়)
- জারাইর (প্রয়োজনের আলোকে সহযোগিতা করা)
- মিনাহ (নির্দিষ্ট মেয়াদে লাভ বা প্রতিদানের আশা ব্যতিরকে কোন সম্পদ কাউকে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া।)
• উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ
১. ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে সৎ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন, দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করে দেশে ও বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানি করা।
২. সম্পদের আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে অবকাঠামো ও আইনি পদক্ষেপ নেয়া।
৩. প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তির ব্যবহার করা। যেমন- সৌরবিদ্যুৎ ও দিনের আলো সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃত্রিম জ্বালানী নির্ভরতা ও ব্যয় কমানো।
৫. বিশেষ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা/পোষের ব্যবস্থা করা। যেমন- বয়স্ক, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি।
৬. ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা ও পর্যায়ক্রমে বিলোপ করা।
শেষকথা:
দরিদ্রতা বিমোচনে ইসলামি অর্থনীতির এটি সামগ্রিক দিক নয় বরং একটি দিক। আবার এখানে আমি ইসলামী অর্থনীতির সামগ্রিক রূপরেখাও নিয়ে আসিনি। অনেকে দরিদ্রতা নিরসনে কেবল যাকাতকেই সমাধান মনে করেন কিংবা ইসলামি অর্থনীতি বলতে কেবল যাকাতভিত্তিক ও সুদহীন অর্থনীতিই মনে করেন। বাস্তবতা হল যাকাত একটি শক্তিশালী ও প্রধান উপকরণ, কিন্তু সাপোর্টিভ আরও অনেক উপকরণ আছে। এছাড়া একটি হোলিস্টিক এপ্রোচ দরকার। ইসলামি হুকুমতে রাষ্ট্রীয়ভাবেই এসব ব্যবস্থাপনা থাকবে। কিন্তু সে তো অনেক দূরের পথ! ততদিন ধাপেধাপে পরীক্ষামূলকভাবে প্রস্তাবিত মডেলে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
মাশাল্লাহ খুব সুন্দর প্রস্তাবনা। লেখা অবিরত থাকুক।
ReplyDelete