|| বাঙালির পরিচয় || বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদন || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||


বাঙালির পরিচয়

বাপ্পা আজিজুল 


ইতিহাস পঠন-পাঠন, লিখন কিংবা অন্বেষায় 'বিশ্বাস' বা দৃষ্টিভঙ্গী একটি মূল চলক হিসেবে কাজ করে। মানুষ, সভ্যতা ও ধর্মের ইতিহাসের বয়স এবং শুরু এক ও অভিন্ন। অন্তত প্রধান কয়েকটি ধর্মমত পর্যালোচন করলে তাই পাওয়া যায়। কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী আধুনিক-সেক্যুলার ইতিহাস বকছে মানুষ বিবর্তনের ধারায় আজকের অবস্থায় আসছে। আদিতে গুহা যাপন, কাঁচা মাংস ভক্ষণ, কৌম সমাজ ইত্যাদি নানা গাল-গল্পতে ঠাসা সেসব বয়ান। ধর্মীয় ন্যারেটিভগুলো বরং গোড়া থেকেই মানুষকে সভ্য, দক্ষ ও নৈতিক হিসেবে তুলে ধরে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদমের ব্যাপারে সেমেটিক ধর্মগুলো সহমত পোষণ করে। তখন থেকে সময় গণনার হিসাব পাওয়া যায়। 'আদম বৎসর' হিসেবে অভিহিত সেই সম্বৎসরেও ১২ মাস ছিল। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সাল গণনা। এরপর নূহের মহাপ্লাবন পরবর্তী তাঁর বংশধর ও সঙ্গীদের মধ্যে 'মহাপ্লাবনের বছর' নামে সাল গণনা শুরু হয়। নূহকে বলা হয় ২য় আদম। তাঁর বংশধর ও সঙ্গীরা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প-বিস্তর যোজন-বিয়োজন বা বিকৃতি সহকারে নূহের প্লাবনের এই মহাআখ্যান বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতির উপকথা বা পুরাণে বর্ণিত আছে। প্রাচীন পৃথিবীর ১ম লিখিত মহাকাব্য 'গিলগামেশ' থেকে শুরু করে মায়াসভ্যতা, ইউরো মিথ, হিন্দুদের মনুসংহিতা বা মাৎস্যন্যায়, এমনকি অস্ট্রো-নিউজিল্যান্ডের উপকথাতেও নূহের প্লাবনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্লাবনটি সংঘটিত হয়েছিল  প্রায় ৮০০০ হাজার বছর আগে। এই বিষয়ে'মহাপ্লাবনের মহামিথ' নামে আমার একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত বলেছি।


সেক্যুলার হিস্ট্রি ও ন্যারেটিভ গত দুশো বছর ধরে আমাদের জানাচ্ছে- মুসলমানরা এই ভূখণ্ডে ইনভেডার বা কলোনাইজার। তারা ৮০০ বছর আগে আসছে। বখতিয়ার খলজি ক্ষেমতা কাইড়া নিছে। তো হাজার কেন? কয়েক হাজার বছর আগে ফিরে গেলে কেমন হয়?



বঙ্গ, বঙ্গাল, বাঙ্গাল, বাঙ্গালা থেকে বাংলা বা বাঙালি ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তনের একেকটি মাইলফলক ও প্রামাণ্য দলিল। আর্য থেকে বাংলা ভাষা বা বাঙালি জাতি কেউ আসেনি। বাঙালির অবস্থান এই ভূখণ্ডে আরও পুরনো। কত পুরনো? ক্রমান্বয়ে তালাশ করা যাক-


১. আজ থেকে প্রায় ৭০০০ বছর পূর্বে এই বঙ্গে ইসলামী সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল। সময়টি আন্দাজ করার কিছু ক্লু দেই। নবি ইবরাহিমের সময় ছিল ৪৫০০ বছর পূর্বে তখন সেখানে চলছিল ক্যালডিয়ো সভ্যতার যুগ। অর্থাৎ বঙ্গীয় সেই ইসলামী সভ্যতা ছিল ইতিহাসখ্যাত 'সুমেরীয়' সভ্যতার (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ) সমসাময়িক।


২. মহাপ্লাবনের পরে নবি নূহের নির্দেশে তাঁর বিশ্বাসী পুত্ররা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েন। ইনভেডার বা কলোনাইজার হিসেবে নয়। পৃথিবীকে আবাদ করতে। এটাকে চাষাবাদ মনে কইরেন না আবার কেউ। বড়পুত্র হাম-কে বলা হল দক্ষিণে যাও, মেঝো সাম-কে মধ্যভাগে আর ছোট ইউফাউসকে নিজের কাছে রেখে দেন নূহ। হাম থেকে হেমেটিক জাতি, সাম থেকে সেমেটিক ও ইউফাউস থেকে ইউরোপীয়দের উদ্ভব। হামের ৬ পুত্র। বড় দুইজন হিন্দ ও সিন্ধকে পাঠানো হল এদিকে। হিন্দের নামে অঞ্চলটি পরিচিত হল হিন্দুস্তান, সিন্ধের নামে গড়ে উঠল সিন্ধু সভ্যতা। হামের অন্য ছেলেগুলোও বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্ব পেল। ৩য় পুত্র হাবাশের বংশধারা হাবশী, ৪র্থ পুত্র জানাজ, ৫ম পুত্র বার্বার, ৬ষ্ঠ পুত্র ছিল নুবাহ। লেখা বাহুল্য, নূহের এই নাতিরা সবাই তাঁর সহবত পাওয়া। তারা আসমানি বাণী ও নবি নূহের দাওয়াতের শিক্ষানুযায়ী ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিনির্মাণ করেছিল। 


৩. হিন্দের ২য় পুত্র ছিল বঙ্গ। সে আবার বাবার নির্দেশে পদ্মা-যমুনার অববাহিকার পললে গড়ে ওঠা এই ভূখণ্ডে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তার নামে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় বঙ্গ। আর তার বংশধরের নাম 'বাঙ্গাল'> বঙ্গ + আল। যদিও আইন-ই-আকবরিতে আবুল ফজল 'আল' প্রত্যয় যোগ হওয়ার একটি হাস্যকর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বাংলা শব্দ 'আল' মানে উঁচু পথ বা বাঁধ, ড্যাম। সাগর-নদী কবলিত এই জনপদে সুরক্ষার জন্য উঁচু উঁচু বাঁধ বা ড্যাম দেয়া হত। তাই বঙ্গের সাথে এই আল যুক্ত হয়েছে। কিন্তু 'বঙ্গ' নামের এই যে নূহ>হাম>হিন্দ>বঙ্গ পরম্পরা এব্যাপারে তিনি একমত। বঙ্গের সন্তানেরা প্রভাব-প্রতিপত্তির সাথে বংশানুগতিক বঙ্গ অঞ্চলে বসতি ও ইসলামী অনুশাসনে পরিচালিত করতে থাকে। সুতরাং মুসলমানেরাই বঙ্গদেশের ভূমিপুত্র। 



৪. হিন্দুস্তানে মূর্তিপূজা কিভাবে এল? হিন্দের বড়পুত্র ছিল পূরব। পূরবের ৪২ সন্তান পিতার কাছে থেকে প্রাপ্ত অঞ্চলের শাসনভার লাভ করে। হামের ৩য় পুত্র দখিন। সে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে বসতি করে। তার মৃত্যুর পর সেটি তার তিন পুত্র মারাত, কানার ও তেলেঙ এর মধ্যে বিভাজিত হয়। দখিনের বংশধর রাজা রাই মহারাজের আমলে পারস্য থেকে একব্যক্তি হিন্দুস্তানে আসে। যে ছিল সূর্যপূজারী। তার মাধ্যমে কিছু মানুষ মোটিভেট হয়। সূর্য ও অগ্নি পূজার প্রচলন শুরু হয়। এরপর রাজা রাই সুরুজের আমলে ঝাড়খণ্ড থেকে এক লোক আসে যে ছিল মূর্তিপূজারী। সে রাজকার্যে যোগ দেয়। সবাইকে তাদের পিতা ও দাদার সোনার মূর্তি গড়ে দেয়, উপহার দেয় শ্রদ্ধা এবং ভক্তিভরে স্মরণের জন্য। কালক্রমে সেখান থেকে মূর্তিপূজার উদ্ভব হয়। সনাতন ধর্মপ্রথাও চালু হয়। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহিম জারদাশ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে অগ্নিপূজার সূত্রপাত হয়। 


৫. বঙ্গ যেহেতু সোসিও-কালচারালি পৃথক ছিল। বঙ্গে শিরক ও মূর্তিপূজার প্রভাব পড়ে কয়েকশো বছর পরে। এমনকি আর্যদের উপনিবেশিক প্রভাবও বঙ্গে পড়ে সবার শেষে ও মৃদু আকারে। যাই হোক, বঙ্গভূমির ১ম সনাতন বা হিন্দুরাজা 'ভগবত'। সে শাসন করে ২১৮ বছর। তখন থেকে ক্ষত্রী রাজবংশের উদ্ভব। আজ থেকে ৫০০০ বছর আগের কথা বলছি। সময়টা মহাভারতের যুদ্ধের আগে।  আর্যরা হিন্দুস্তানে এসেছে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০-১৫০০ বছর সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে পালাক্রমে। তো এই হিন্দু রাজারা (৬১ জন) বঙ্গভূমি শাসন করেছে ৪৫৫৪ বছর সেন বংশ পর্যন্ত। মাঝখানে কিছু বৌদ্ধশাসক ছিল। এরপরে বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে বঙ্গভূমি দিল্লীর মুসলিম শাসকের কাছে পদানত হয়। বলা যায়, মুসলমানেরা আবার তাদের শাসনাধিকার ফিরে পায়। 


৬. সুতরাং বঙ্গদেশে নিম্নবর্ণ হিন্দু, বৌদ্ধ, কোল, বাউরি, চামুণ্ডা থেকে মুসলমানের উদ্ভব, এই মেটান্যারেটিভও আর ধোপে টিকে না। বরং মুসলমান থেকে ক্রমেই বিচ্যুতির মাধ্যমে সনাতন ধর্মের উৎপত্তি বলা যায়। এছাড়া নৃপরিমিতির ভিত্তিতে নৃতাত্ত্বিকভাবেও প্রমাণিত যে, বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুরা একই নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পৃথক নয়। বাঙালি মুসলমানের গড় শিরাংক ৭৮, নাসাংক ৭৭.৫ এবং দেহের উচ্চতা ১৬৩.৪ সেমি। অন্যদিকে বাঙালি ব্রাহ্মণের গড় শিরাংক ৭৮.৭, নাসাংক  ৭০.৮, উচ্চতা ১৬৫.৮ সেমি। নৃতাত্ত্বিক পরিসংখ্যানগত পার্থক্য খুবই নগণ্য। 


৭. বাঙালির রক্তে মিশে আছে কারা? বঙ্গদেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। এদের মধ্যে অস্ট্রিক বা নিষাদ, দ্রাবিড়, মঙ্গল, আর্য, আরব, তুর্কি, পাঠান, আফগান, ভোটচিনীয় কে নেই? এর মধ্যে দ্রাবিড়ীয় মিশ্রণাধিক্য ধরে নেয়া হয়। দ্রাবিড় একটি নৃগোষ্ঠী যাদের উদ্ভব ৪০০০ বছর আগের কোন এক সময়ে। যাদের বসতি ছিল দক্ষিণ ভারতে। মূলত দ্রাবিড়> দার আল আবির থেকে উদগত। কে তাহলে আবির? আবির নিজেও ছিলেন নবি নুহের প্রপৌত্র। নুহ> সাম> সালাহ> আবির। আরবিতে আবির, হিব্রু হেবের। তার বংশধরেরা শাম বা সিরিয়া থেকে হিন্দুস্তানে এসে বসতি করে। যারা দ্রাবিড় হিসেবে পরিচিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই রুট থেকেও বাঙালি আরব রক্তধারা পেয়েছে। পরবর্তীতে আল্লাহর রাসুল সা. এর সময়ে ৪ জন সাহাবা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চীনের ক্যান্টনে পৌঁছায়। এই রুটে আরব বণিক ও সুফিদের মাধ্যমে আরেক দফা আরবীয় রক্তধারা বাঙালির রক্তে মিশে যায়। রক্তধারা বিশ্লেষণে গড়ে একজন বাঙালির রক্তে ৫২% পূর্বভূমধ্যসাগরীয়,  ২৬% দ্রাবিড়, ১০% নিষাদ এবং ১২% বৈদিক আর্য ধারা বিদ্যমান। এর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বাঙালি মুসলমানের রক্তে ৫০.৮% পূর্বভূমধ্যসাগরীয়, ২৮.৬% দ্রাবিড়, ১৬.৮% নিষাদ এবং ৩.৭% আর্য রক্তধারা বহমান। অন্যদিকে বাঙালি ব্রাহ্মণের রক্তে ৭৪% পূর্বভূমধ্যসাগরীয়, ১০.৫% দ্রাবিড়, ৩.৮% নিষাদ এবং ১১.১% আর্য ধারা প্রবাহিত। এখানে পূর্বভূমধ্যসাগরীয় বলতে মূলত নবি নূহের আদি বংশধারা বুঝাচ্ছে। কেননা তারা মহাপ্লাবনের আগে সেই অঞ্চলে বসবাস করত।  


তথ্যসূত্র:

১. আইন-ই-আকবরি, আবুল ফজল আল্লামী

২. Riyazus Salatin- A history of Bengal by Ghulam Hossain Saleem, originally written in Persian. Translated to English by Maulavi Abdus Salam, Published by Asiatic Society, Calcutta, 1902

৩. বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ, ৪র্থ খণ্ড

৪. Land of two rivers by Nitish Sengupta (A history of Bengal from the Mahavarata to Mujib)

৫. বাঙালির ধর্ম ও সমাজ, যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 


No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.