|| সাহিত্য, ধর্ম, ও বিজ্ঞান || খন্দকার রেজাউল করিম || মানসলোক ||

 

সাহিত্য, ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন খন্দকার রেজাউল করিম 


সাহিত্য, ধর্ম, এবং বিজ্ঞান। কে সবার আগে এসেছে? সুর এবং গান যদি সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধরা হয় তবে সাহিত্য এসেছে সবার আগে, প্রায় লক্ষ বছর আগে। তারপরে ধর্ম এবং বিজ্ঞান, যথাক্রমে দশ হাজার এবং আড়াই হাজার বছর আগে। বিজ্ঞান আসার অনেক আগে মানুষ সাহিত্য, কবিতা, এবং গান রচনা করেছে। বিজ্ঞানের অনেক আগে আমরা অজানা এক শ্রষ্ঠাকে ভয় করেছি, তাঁর ধারণা আমাদের চেতনায় ঢুকে পড়েছে, হয়তো বা আমাদের ডিএনএ তে শিকড় গেড়ে বসেছে। সূর্যের কাছে, আকাশের কাছে, প্লাবন, মহামারী, এবং ভূমিকম্পের কাছে আমরা নিজেকে তুচ্ছ মনে করেছি। ভয়ে এবং বিস্ময়ে আমরা শ্রষ্ঠার বন্দনা করেছি, ধর্মসংগীত গেয়েছি। 


গোঁড়ামি এবং অন্ধ বিশ্বাস ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে যুগেযুগে প্রভাবিত করেছে, যদিও ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের বেশি পরিচিত। ‘In the absence of any other proof, the thumb alone would convince me of God's existence,’ নিউটন বলেছিলেন। এখানে মহাবিজ্ঞানী নিউটন বিশ্বাসীর মত কথা বলছেন। মানুষের বুড়ো আঙুলের বৈচিত্র্য এবং স্বতন্ত্রতা একজন স্রষ্ঠার ইঙ্গিত দিতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন (conjecture) বা সিদ্ধান্ত বলা হয়। প্রমান না হলেও এমন ইঙ্গিত সম্ভবনার কথা বলে। তবে শুধু একটা নিদর্শনের উপরে এতটা ভরসা করা ঠিক না। কিন্তু এমন অনেক ইঙ্গিত থেকে সৃষ্টিকর্তার উপরে যে বিশ্বাস জন্মাতে পারে তাকে অন্ধ বিশ্বাস বা গোঁড়ামি বলা যায় না।


বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ। সৃষ্টিকর্তা মানুষের ইন্দ্রিয় বা যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়েন না, তাই সৃষ্টিকর্তা আছেন না নেই তা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমান করা সম্ভব নয়। এই সব ইঙ্গিত বা নিদর্শনই একমাত্র ভরসা। প্রকৃতি এবং ধর্মগ্রন্থগুলিতে এমন ইঙ্গিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গ্যালিলিও বলেছিলেন যে ঈশ্বর প্রকৃতি এবং ধর্মগ্রন্থে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞানীরা প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে, ধর্ম-পন্ডিতরা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে। বিজ্ঞান এবং ধর্মের মাঝে সংঘাত কেন শুরু হলো?


বিজ্ঞানের ইতিহাস একটু উল্টেপাল্টে দেখা যাক। যীশুখৃষ্টের জন্মের আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০-১০০) পৃথিবী গোল না চ্যাপ্টা, ঘুরছে না স্থির হয়ে বসে আছে, সূর্য নক্ষত্র না দেবতা, নক্ষত্র অমর না মরণশীল, পদার্থ কী দিয়ে তৈরী, ইত্যাদি ছিল বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। গ্রিক বিজ্ঞানী সক্রেটিস, ডেমোক্রিটাস, প্লেটো, এরিস্টটল, এরিসটারকাস এসব নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। যীশুর জন্মের পরে আলেক্সান্ড্রিয়ার টলেমি (খ্রিস্টাব্দ ১০০-১৭০), ভারতের আর্যভট্ট (৪৭৬-৫৫০) এবং ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৭-৬৬৮) জ্যোতির্বিজ্ঞানে গণিতের প্রয়োগ করেন। এরপরে কয়েক'শ বছর ধরে চলে মুসলমান বিজ্ঞানীদের একটানা রাজত্ব: আল খুরাইজমি (৭৮০-৮৪৭), আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩), আল-ফারাবী (৮৭০-৯৫০), আল-হাইসাম (৯৬৫-১০৪০), ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭), আল বিরুনী (৯৭৩-১০৫০), ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১), ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮), আল-তুসি (১২০১-১২৭৪), ইবনে খালেদুন (১৩৩২-১৪০৬), প্রভৃতি। ভারতীয় এবং মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে ধর্ম কোনো বাধা ছিল না, বরং বিজ্ঞান সাধনা ছিল ধর্মের অংশ। 


জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের যখন স্বর্ণযুগ, ইউরোপে তখন চলছিল খৃস্টানদের অন্ধকার যুগ। ১৫০০ সালের দিকে মুসলমানদের অন্ধকার যুগ শুরু হলো, ইউরোপে আসলো জ্ঞানবিজ্ঞানের নবজাগরণ। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, এবং কেপলারের সূর্য-কেন্দ্রিক চলন্ত পৃথিবী খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানে। গ্যালিলিওকে তাঁর জীবনের শেষ দশ বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয়, কেপলারের মা'কে ডাইনি বলে কারাগারে পাঠানো হয়, ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। নিউটন এসে পৃথিবী এবং আকাশ একই সমীকরণে বেঁধে ফেললেন, দেখালেন যে আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র এবং পৃথিবীর ফুটবল, কামানের গোলা, দোলনা একই নিয়ম মেনে চলে। এই বিজ্ঞানীরা সবাই ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিলেন, নিউটন যদিও খ্রিষ্টধর্মের ট্রিনিটি তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। এই বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম থেকে ধর্মের গোঁড়ামিকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। বিজ্ঞানের হাতধরে দর্শন এগিয়ে আসলো নতুন সব যুক্তি নিয়ে। রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০), স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭), ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬), ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪), কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩), নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০), সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০); এঁরা কেউ ধর্ম এবং ঈশ্বরের পক্ষে এবং কেউ বা বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।  


১৮৫০ সাল থেকে ২০০০ সাল ছিল বিজ্ঞানের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়। এই সময়ের জাঁদরেল বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক (১৮৫৮-১৯৪৭), আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫), এবং শ্রোডিঙ্গার (১৮৮৭-১৯৬১) ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন, যদিও প্রচলিত কোনো ধর্মের রীতিনীতি পালন করতেন না। ধর্মের বদলে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতা (secular humanism) হয়ে গেল বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকের পছন্দের জীবনদর্শন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ধর্মগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যাবে, "Unto you is your religion, unto me is my religion [Quran 109:6], "In my Father's house are many mansions, if it were not so, I would have told you. I go prepare a place for you." [John 14:2]৷ মানবিকতার কথা ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় লেখা আছে। তবুও গোঁড়া ধার্মিকরা ধর্মনিরেপক্ষতাকে ধর্মহীনতা ভেবে অকারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। প্রচলিত ধর্মের বাইরে যে মানবিকতা বিরাজ করে তাকে এরা অস্বীকার করতে চায়। 


ধর্মগ্রন্থে যাই লেখা থাক, মানুষ নিজের আদলে ধর্ম এবং ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। স্পিনোজা বলেছেন, If a triangle could speak, it would say, that God is eminently triangular, while a circle would say that the divine nature is eminently circular. 


রবীন্দ্রনাথ একই কথা বলেছেন,

"ওরা ডাকে আমায় পূজার ছলে, এসে দেখি দেউল-তলে--

আপন মনের বিকারটারে সাজিয়ে রাখে ছদ্মবেশে"।


যে দয়ালু, সে তার ধর্মগ্রন্থে দয়ার কথা খুঁজে পায়, তার ঈশ্বর হয় করুনাময়। যে নিষ্ঠুর, সে ধর্মগ্রন্থে নিষ্ঠুরতা খুঁজে পায়। যে খুনোখুনি পছন্দ করে, সে ধর্মগ্রন্থে রক্তের গন্ধ পায়। যে শান্তি চায়, ধর্মগ্রন্থ তার জন্যে শান্তির বাণী বয়ে আনে। মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষে, জাতি-উপজাতিতে যত বিভেদ, ক্ষমতাবানরা ততই নিরাপদ। সুবিধাবাদী শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে বিভেদ সৃষ্টির কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার করে। অধিকাংশ লোকের ধর্মবিশ্বাস জন্মসূত্রে পাওয়া, ধর্মপণ্ডিতদের মুখের কথা ক্রমাগত শুনে শুনে এই বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে নয়।


ইদানিং গোঁড়ামি বিজ্ঞানে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বিজ্ঞানী সক্রিয়ভাবে নাস্তিকতা প্রচার করছেন। এঁরা মনে করেন যে একদিন বিজ্ঞান মহাবিশ্বের সব রহস্যের সমাধান করবে, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিবে, ঈশ্বরের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। এটা একটা অন্ধ বিশ্বাস। মধ্যযুগের ধর্ম মোড়লরা বিজ্ঞানীদের কারাগারে পাঠিয়েছে। এ যুগের হামবড়া বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসীদের একঘরে করতে চান। তবে বিজ্ঞানে কোনো মোড়লতন্ত্র নেই। ‘To punish me for my contempt for authority, fate made me an authority myself,’ আইনস্টাইন দুঃখ করে বলেছেন। আমরা জানি না, কোনোদিন জানতে পারবো না, এমন কথা বলতে এই বিজ্ঞানীরা নারাজ। অথচ বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যত রহস্যের সমাধান করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রহস্যের জন্ম দিয়েছে।


সাহিত্য, কবিতা, গান সরাসরি মানুষের কথা বলে। সবার উপরে মানুষ সত্য, এ কথা সাহিত্য যেমন সহজে শিখিয়েছে, ধর্ম বা বিজ্ঞান তেমনটি পারে নি। ক্ষুধায় আমাদের সবার পেট যে একই ভাবে জ্বলে, সাহিত্যে সে খবর মেলে। সাহিত্য নিপীড়িত মানুষের কথা, কিশোর কিশোরীর প্রেমের গল্প। সাহিত্য পাপীর হৃদয়ে পূণ্য খুঁজে পায়, পুণ্যবানদের মাঝে পাপ খুঁজে পায়, ধর্ম বা বিজ্ঞান যা পায় না। সাহিত্য মানুষে মানুষে ভালবাসার বন্ধন তৈরী করে। গোঁড়ামি বিভেদ আরো বাড়িয়ে দেয়। লালন ফকির গান শুনিয়ে মানুষের মাঝে যে মানবিকতা সহজেই সৃষ্টি করতে পারেন; ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শনের পন্ডিত তা পারেন না। 


কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে গোঁড়ামি স্থান পায় নি, বিভেদ এবং গোঁড়ামির সাহিত্য কখনো জনপ্রিয় হয় নি। সাহিত্য হলো গোঁড়ামি ভাইরাসের টিকা। করোনা ভাইরাসে পৃথিবীতে যত লোক মরেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মরেছে গোঁড়ামি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। যে বই পড়ে, সে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ভাঙতে যায় না, সংখ্যালঘুদের মাথায় লাঠির বাড়ি মারে না, অন্য ধর্ম বা জাতির লোককে খুন করতে যায় না। আপনি যে ধর্মেরই লোক হন না কেন, সাহিত্য আপনাকে অধর্ম থেকে দূরে রাখবে। নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন। গোঁড়ামি ভাইরাসের টিকা নিন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়ুন, গান শুনুন। অনেক ধরণের গান, অনেক লেখকের বই। সাহিত্য অধর্ম থেকে আত্মরক্ষার টিকা। এই টিকা পর্যাপ্ত পরিমানে নিন। গোঁড়ামি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।

(লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে)

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.