বাংলাভাষার বিকাশ ও নিরন্তর সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস|| বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||

বাংলাভাষার বিকাশ ও নিরন্তর সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাপ্পা আজিজুল



বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। বাংলা এখন অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। মাতৃভাষায় কথা বলার সংখ্যায় বিশ্বে ৪র্থ এবং ভাষাভাষী ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে ৫ম। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঞ্চল মিলিয়ে সারাবিশ্বে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। শতকরা হিসেবে পৃথিবীর ৩ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলাভাষার রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছর সমৃদ্ধ ইতিহাস। এর উৎপত্তি নিয়ে মোটাদাগে দুটি মত পাওয়া যায়। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, মাগধী প্রাকৃত থেকে দশম শতাব্দীতে বাংলার উদ্ভব হয়। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন, বৌদ্ধ সহজিয়া ভিক্ষুদের গীতিকাব্যের নিরিখে শেষোক্ত মতকেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করা যায়। 

বাংলাভাষার বিকাশ, সংগ্রাম ও আন্দোলনকে ৩টি যুগে ভাগ করা যায়- ১. আদি যুগ ২. মধ্যযুগ ৩. আধুনিক যুগ

১. আদিযুগ

বাংলাভাষার উৎপত্তিকাল ও শৈশব পার করেছে পাল ও সেন যুগে। পালি ও সংস্কৃত ভাষা ছিল যথাক্রমে রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের মুখের ভাষা। সরকারি ভাষা। চর্যার কবিরা তাই গোপনে, নিভৃতে চর্চা করেন বাংলা। লেখা বাহুল্য, আজন্ম লড়াইয়ে নিয়োজিত হতে হয় বাংলাকে। 

২. মধ্যযুগ

মধ্যযুগের স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে তার স্বীকৃতি মেলেনি। আরবি, ফারসি ছিল সেসময়ের অভিজাতদের ভাষা। এদিকে মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় 

উপমহাদেশে আরবি লিপিতে নতুন যে হিন্দুস্থানী ভাষার সৃষ্টি হয়, সেটিই উর্দু। এছাড়া দেবনাগরী লিপিতে হিন্দুস্থানী হিন্দী ভাষা বরাবর বলবৎ ছিল। বাংলাকে তাই মধ্যযুগে আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দী মহাজোটের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। যেমনটি আমরা পাই কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) এর কবিতায়। সাহিত্য নিয়ে সবার বয়ান সত্য নয়। সাহিত্যের পটকে সমসাময়িক সামাজিক ইতিহাস দিয়ে বিচার করলে আমাদের কাছে অনেক আড়াল হয়ে যাওয়া সত্য উন্মোচিত হবে। কবি আব্দুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতারও ভুল ব্যাখ্যা আমাদের শেখানো হয়। 

“আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।

দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।

আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।

যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।

যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।

সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন”। 

ধর্মবিদ্বেষীরা এখানে খড়গটা চালায় আরবি-ফারসি ভাষার উপরে। সযত্নে এড়িয়ে যায় পাশে থাকা হিন্দীকে (সংস্কৃতকেও)। অথচ এখানে কোন ভাষার প্রতি কবি বিষবাষ্প ছড়াননি। 

৩. আধুনিক যুগ

উপনিবেশ যুগের উদরে বাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলাবিভাগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে উপমহাদেশে বাংলাভাষার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৭৭৮ সালে ইংরেজিতেই প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়। ১৮৩২ সালে প্রথম বাঙালি হয়েও রাজা রামমোহন রায় ইংরেজিতেই লেখেন 'দ্য গ্রামার অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ'। খুব পরিকল্পিতভাবে আরবি-ফারসির প্রভাবকে ক্ষীণ করে সংস্কৃত বা তৎসম শব্দসংবলিত রেনেসাঁর উত্থান ঘটানো হয়। আধুনিক যুগের ভাষা আন্দোলনকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়- ক. দেশ বিভাগপূর্ব খ. দেশ বিভাগোত্তর

ক. দেশ বিভাগপূর্ব

১৯০০ সালে যুক্তপ্রদেশের গভর্নর উর্দুকে দাপ্তরিক ভাষা থেকে বাতিল করে দেবনাগরী লিপিতে হিন্দীকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে মুসলমানেরা সংক্ষুব্ধ হয়। চলে আসে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকার ইস্যু। হিন্দু বা কংগ্রেসপন্থিরা হিন্দীকে সাধারণ ভাষা হিসেবে দেখতে চায়, অন্যদিকে মুসলিমরা উর্দুকে সাধারণ ভাষা হিসেবে দাবি করে। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুসভাপতিত্বে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার স্বপক্ষে সভা করা হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয়তে ('ভারতের রাষ্ট্রভাষা' শিরোনামে) বলা হয়- গান্ধীজী শুরুতে রাষ্ট্রভাষার মীমাংসা করতে বলেছিলেন, "আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে হিন্দুস্থানী, আরবী বর্ণমালায় লিখিত হইলে যাহার নাম হইবে উর্দু এবং দেবনাগরী বর্ণমালায় লিখিত হইলে যাহাকে বলা হইবে হিন্দী"। পরে তিনি সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলেন- "ভাবী রাষ্ট্রভাষা হইবে  'হিন্দী'-হিন্দুস্থানী"। দৈনিক আজাদেত সেই সম্পাদকীয়তে এটিও বলা হয় যে, "এই হিন্দী ভাষার কোন উচ্চাঙ্গ সাহিত্য নাই, ইহার শব্দসম্পদও বেশী নয়। বাঙ্গলার চেয়ে এই বাজার চলতি 'হিন্দুস্থানী'র রাষ্ট্রভাষা হইবার যোগ্যতা নিশ্চয়ই বেশী নয়"। সমগ্র চল্লিশের দশকজুড়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কবি ফররুখ আহমদ, প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রমুখ বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নিয়মিত তাদের লেখালেখি ও বক্তব্যে সোচ্চার ছিলেন। দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক মোছলেম, মাসিক মোহাম্মাদী, মাসিক সওগাত প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা এতে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন দেয়। 

খ. দেশ বিভাগোত্তর

১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট দেশভাগ হয়। নবসৃষ্ট পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ধর্ম ব্যতিরকে আর কোন ঐক্য ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবারও সামনে চলে আসে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ইস্যু। উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তান অংশে মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। খোদ পশ্চিমের কোন কোন প্রদেশেও বিরোধিতা শুরু হয়। নয়া দেশ পাকিস্তান গঠনের ১৫ দিনের মাথায় (১ সেপ্টেম্বর) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আবুল কাশেমের (পরবর্তীকালে বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আধা রাজনৈতিক, আধা সাংস্কৃতিক সংগঠন 'তমদ্দুন মজলিশ' যা মূলত তৎকালীন জনপ্রিয় ইসলামি দল খেলাফতে রব্বানী পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা। ১৫ সেপ্টেম্বর তারা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে- 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু'? তমদ্দুন মজলিশ তৎকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাভাষার সপক্ষে প্রথম সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা শুরু করে। সভা-সেমিনার করে। 'সৈনিক' নামে একটি মুখপত্র পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে। দেশ বিভাগোত্তর ভাষা আন্দোলন-সংগ্রামের দুটি পর্ব লক্ষ্য করা যায়- ১. ৪৭-৪৯ বুদ্ধিবৃত্তিক পর্ব

২. ৫২'র গণ আন্দোলন পর্ব


১. ৪৭-৪৯ বুদ্ধিবৃত্তিক পর্ব

এই পর্বটি তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে সংগঠিত ও সংঘটিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন হল কেন্দ্রিক ছোট ছোট সাহিত্য সভা, স্মারকলিপি পেশ, পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ৪৭ সালের অক্টোবর, নভেম্বর মাসেই এগুলো পুরোদস্তুর চলতে থাকে। ঢাবি ফলিত রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক ড. নূরুল হককে (তমদ্দুন মজলিশের কর্মী) প্রধান করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মজলিশের অফিসই সংগ্রাম কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৪৭'র ৫ ডিসেম্বর করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয় এমন সংবাদ প্রকাশিত হলে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বেলতলায় প্রথম প্রতিবাদী সভা ও সভা উত্তর মিছিল বের হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ এর অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ঘোষণার দাবি উত্থাপন করেন। ১১ই মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মাইলফলক। এদিন দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়। সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং এ অংশ নেয়- মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিব, গোলাম আযম, শামসুল হক প্রমুখ ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ। উল্লেখ্য, ধর্মঘটের খবর পত্রিকায় পাঠ করে শেখ মুজিব পিকেটিং করার জন্য ১০ মার্চ রাতে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় পৌঁছেন। পুলিশের বেদম প্রহার ও গ্রেপ্তারের শিকার হয় অনেকে। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশ ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন। সেই প্রেক্ষিতে আট দফা দাবি সংবলিত স্মারকপত্র তার সামনে পেশ করা হলে তিনি তা মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে স্বাক্ষর করে দেন। ২১ ও ২৪ মার্চ কায়েদে আযম জিন্নাহ যথাক্রমে রেসকোর্স ময়দান ও কার্জন হলে ভাষণে 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্রজনতা 'নো' 'নো' ধ্বনি করে। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রসভায় যোগ দিলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ডাকসুর জিএস গোলাম আযম রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে স্মারকলিপি দেন ও পাঠ করে শোনান। 

২. বায়ান্ন'র গণ আন্দোলন

৪৮ এর ১১ই মার্চের গ্রেপ্তার ও পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রতিবছর ১১ই মার্চ 'রাষ্ট্রভাষা দিবস' পালিত হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নিয়মিত কিছু কার্যক্রম ছাড়া ৫০-৫১ তে উল্লেখযোগ্য তেমন ঘটনা পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে তমদ্দুন মজলিশের কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। ৫২'র গণ আন্দোলন শুরু হয় মূলত ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন এর পল্টন ময়দানে উর্দুর স্বপক্ষে দেয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। সেখানে তিনি 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' ঘোষণা করেন যা তার সাথে ইতঃপূর্বে করা চুক্তির খেলাপ। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাবিতে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদ গঠিত হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আসন্ন প্রাদেশিক সরকারের বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত্রি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের বৈঠকে ভোটাভুটির মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ছাত্ররা ঢাবির ফজলুল হক ও সলিমুল্লাহ হলে সভার ডাক দেয়। উভয় সভাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় আসে। ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে বারোটায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আমতলার ঐতিহাসিক সভায় বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনের আগুন ঝরানো বক্তব্যের প্রেক্ষিতে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী, জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ঢাবি ক্যাম্পাস ও ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গনে ক্রমাগত প্রতিবাদী মিছিল ঠেকাতে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস, লাঠিচার্জ ও গুলি ছোড়ে। শহীদ হন সালাহউদ্দীন, সালাম, রফিক, বরকত, সফিউর, জব্বারসহ অনেকে। প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজা ও জানাজা উত্তর সভা ও জঙ্গী মিছিলের কর্মসূচি পালিত হয়। উক্ত জঙ্গী মিছিলে পুনরায় মুহুর্মুহু গুলি বর্ষিত হলে আরও ৪ জন শহীদ হন, আহত হয় শতাধিক। এভাবে ঘটনা প্রবাহ পুরো মার্চ জুড়েই চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। 


ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল:

১. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি মেলে। 

২. বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম হয়। বাংলাসাহিত্যের কলকাতাকেন্দ্রিক রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশী বাংলাভাষার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষার গতি পশ্চাৎমুখী হতে থাকে। 

৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়। 

৪. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে রবীন্দ্র প্রভাবিত বাম, ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ও রাজনীতির উত্থান হয়। 


বাংলাভাষার নিরন্তর সংগ্রাম কিন্তু শেষ মনে করলে ভুল হবে। বাংলাভাষা এখনও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে হিন্দি ও ইংরেজির ভয়াল থাবা সর্বদায় বাংলাকে সংগ্রামে লিপ্ত রেখেছে। বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের পৌনে এক শতাব্দী পরে এসেও 'সর্বস্তরে বাংলাভাষা'র ব্যবহার অধরা রয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রয়োগ অভিলাষী বলেই বিবেচ্য হতে পারে। তথাপি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন, বিভিন্ন ভাষা থেকে প্রচুর পারিভাষিক শব্দ তৈরি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক অনুবাদ হয়ত অদূর ভবিষ্যতে সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহারকে সহজ ও সফল করবে। 


No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.