আত্মার রোগ ও চিকিৎসা || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||
আত্মার রোগ ও চিকিৎসা
বাপ্পা আজিজুল
ভূমিকা
সৃষ্টির পর থেকে মানুষের নিরন্তর জিজ্ঞাসা আমি কে? আমি কেন পৃথিবীতে এসেছি? আমার দায়িত্ব কী? আমার অধিকার কী? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষ আশ্রয় নিয়ে নিয়েছে যুক্তির, দর্শনের, ইতিহাসের, ধর্মের, বিজ্ঞানের, নিজস্ব অভিজ্ঞতার, স্বপ্নের আরও কত কী? মানুষ দেহ (body), মন ((mind), আত্মার (soul) এক অপূর্ব সমন্বয়। ধর্মসমূহ স্বাভাবিকভাবে এই সম্মতি দিলেও দর্শন মানুষকে সাপেক্ষ সত্তা (contingent being) হিসেবে দেখে দেহ-মনই যার সারসত্তা, যদিও হেগেল ছিলেন ব্যতিক্রম; তিনি আত্মার গুরুত্ব স্বীকার করলেও তা বহুল প্রচার পায়নি। কোন কোন দর্শন মানুষের কর্ম ও ভালো-মন্দ বোধ, দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রাধান্য দিয়েছে। মহাকবি মিল্টনের দেয়া শিক্ষার সংজ্ঞা 'Education is the harmonious development of body, mind & soul' থেকে মানুষের পূর্ণাঙ্গ সত্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। অধুনা বিজ্ঞানও সেই পথে হেঁটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দেয়া স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'Health is a state of complete physical, mental, social, emotional and spiritual well-being, not merely the absence of disease or infirmity'। ইসলাম দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয়ে একক মানুষের ধারণা দেয়। তাই রাসুল সা. বলেছেন, ঈমানদারদের সাথে একজন ঈমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ঈমানদারদের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৩৪০)। মুমিনগণ একটি দেহের মত। দেহের যে অংগেই কষ্ট হোক না কেন তাতে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে (বুখারি, ৬০১১; মুসলিম, ২৫৮৬)।
আত্মা কী?
আত্মা বা soul বলতে ইসলামের কয়েকটি পরিভাষার সমন্বিত রূপকে বোঝায়। যেমন- রূহ, নফস, কলব, আকল ও ফিতরাত। এগুলো কখনও এককভাবে আত্মা কিংবা একাধিক বা সমন্বিত অর্থে 'আত্মা' হিসেবে বোঝানো হয়। ইসলামি সাইকোলজির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শব্দ- রূহ, ক্বলব ও নফস নিয়ে আজতক পরিষ্কার কোন বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা আসেনি। সুতরাং মানুষের কোন অঙ্গ দিয়ে এগুলোকে সনাক্ত করা কঠিন। এগুলোকে মেটাফিজিক্যাল বা আধ্যাত্মিক হিসেবে ধরাটা যুক্তিযুক্ত। আবার এগুলোর মিস্টিক বা সুফি ঘরানার কিছু ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিকর, হাস্যকরও বটে। ইসলামি জ্ঞানতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দর্শন, সুফিবাদ, তাযকিয়া, রুকইয়াহ, দাওয়াহ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ভালোভাবে বুঝে অনুশীলন করতে চাইলে কিছু প্রধান ও অপ্রধান বিষয় খুব ভালোভাবে জানা, স্বচ্ছ ধারণা ও প্রায়োগিক দক্ষতা তৈরি করা দরকার। এগুলো খুবই মৌলিক এবং পরস্পর সংযুক্ত। এদের উপর ভিত্তি করে উপর্যুক্ত জ্ঞানগুলো বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
* প্রধান বিষয়গুলো ৫ টি:
১. রূহ
২. কলব
৩. নফস
৪. আকল
৫. তাকদির
* অপ্রধান বিষয়গুলো:
১। ফিতরাত
২। ইরাদা বা স্বাধীন ইচ্ছা
৩। শয়তান
৪। জিন
এগুলো বুঝে নিতে হবে কুর'আন, হাদিস ও সালাফদের ঐতিহ্য থেকে। কারণ এই তিনটি মানদণ্ড অনুসরণ করলে বিচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই। একালের অনেকে রূহ, নফস, কলবকে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে মেলাতে চান। এই বিষয়ে কিছু জরুরি কথা-
১. রূহ
"ক্বুলুর রুহু আমরি রাব্বি"- বলো, রূহু হল আল্লাহর আদেশ। এই আদেশ হল জীবন। আর মেডিকেলের ব্যাখ্যায় আমরা জানি এটি এমন একটি শক্তি যা শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখে। হৃদপিণ্ডে স্পন্দন হয়। রক্ত প্রবাহিত করে। আদেশ নাই, শ্বাস নাই, রক্ত পরিবহন নাই, জীবন নাই। যেহেতু রূহকে নিয়ে গিয়ে ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে রাখা হচ্ছে, তাহলে এটিকে আর মানবদেহের কোন কিছুর সাথে যুক্ত করার সুযোগ থাকছে না। আবার কুরআনের পরিভাষায় জিবরীল আমিনকেও রূহ বলা হয়। ঈসা আ.কে বলা হয় রূহুল্লাহ। রূহের গতি উর্ধ্বমুখী। উপযুক্ত খোরাক পেলে রূহ মানুষকে আল্লাহর দিকে অগ্রসর করে ও আখিরাতমুখী করে।
২. কলব
কলব শব্দটি ক্বফ-লাম-বা ধাতু থেকে উদগত। ধাতুটি ৯ টি রূপে ১৬৮ বার কুর'আনে ব্যবহৃত হয়েছে। মোটাদাগে এটির ধাতুগত অর্থ পরিবর্তনশীল অবস্থা, ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা, ভেতরে প্রবেশ করা ইত্যাদি। মুনকালিবুন মানে প্রত্যাবর্তনকারী। মুনকালাবিন মানে অরাজক পরিস্থিতি বা সময়। মুতাকাল্লাবুন এমন সময় কিংবা স্থানকে বলা হয় যেখানে মানুষ খুব ব্যস্ত থাকে। কলবের বাংলা 'অন্তর' বা 'হৃদয়' করা হয়। ইংরেজি তরজমায় Heart বলা হয়। অনেকে রাসুলুল্লাহর ঐ হাদিসের সাথে যুক্ত করে বুকের বাম পাশের মাংসপিণ্ড বলতে হার্ট হিসেবে পরিগণিত করে। কিন্তু ঐ হাদিস বা সম্পূরক আরও হাদিসে কলবে গুনাহের জন্য কালো দাগ পড়ে, কলুষিত হয়। আপনি হার্ট কেটে টুকরো টুকরো করলেও তার অস্তিত্ব পাবেন না। আবার কুরআন-হাদিস থেকে আমরা ১১ ধরণের কলবের নাম পাই। এর মধ্যে প্রধানত ৪ ধরণের কলব উল্লেখযোগ্য- মুমিনের কলব, মুনাফিকের কলব, কাফিরের কলব, পাথরের ন্যায় শক্ত কলব। মুমিনের কলব হল সহিহ, বিশুদ্ধ, অনুগত, শান্তিপূর্ণ, ঈমানে পরিপূর্ণ। মুনাফিকের কলব বক্র, রোগাক্রান্ত, অমনোযোগী। কাফিরের কলব হল মৃত, গাফিল, মোহর মারা বা সীলগালা করা। এগুলো কিন্তু হার্টের টাইপ না। এগুলো মানুষের আচরণ, ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে বর্ণনা ও প্রকাশ করে। সুতরাং কলবকে হার্ট বলার সুযোগ নেই। কলব কখনও রূহের দিকে ধাবিত হয়, কখনও নফসের দিকে ধাবিত হয়। যেদিকে ঝোঁক বেশি থাকে সেদিকের আচরণ, কর্ম ও চরিত্র পরিস্ফুটিত হয়।
* কলবে মুতমাইন্না বিল ঈমান (ঈমানে পরিপূর্ণ অন্তর)
* কলবে মুনিব (অনুরক্ত অন্তর)
* কলবে সালিম (অনুগত অন্তর)
* কলবে সহিহ (বিশুদ্ধ অন্তর)
* কলবে লাহি (অমনোযোগী অন্তর)
* কলবে যায়িগ (বক্র অন্তর)
* কলবে মারিদ্ব (রোগাক্রান্ত অন্তর)
* কলবে গাফিল (উদাসীন অন্তর)
*কলবে মাইয়েত (মৃত অন্তর)
* কলবে খাতিম (মোহর দেয়া অন্তর)
* কলবে ক্বাসী (পাথরের ন্যায় শক্ত অন্তর)
৩. নফস
নফস কুরআনে কোথাও আত্মা, জীবন, ব্যক্তি আবার প্রবৃত্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একবচনে নফস, বহুবচনে আনফুস, নুফুস। কুর'আনে নফস ধাতুটি ৪টি রূপে ২৯৮ বার বর্ণিত হয়েছে। ধাতুগত বিভিন্ন ধরণের অর্থ আছে- শ্বাস নেয়া, সন্তান জন্ম দেয়া, রক্ত, ইচ্ছে, কর্মক্ষমতা, প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি। আমরা বিভিন্ন ধরণের নফসকে জানি। তার মধ্যে ''আম্মারা' খারাপ যা প্রবৃত্তি দ্বারা শাসিত হয়। একে আমরা মানুষের মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের সাথে তুলনা করতে পারি। যেখানে প্লেজার/রিওয়ার্ড সেন্টার আছে। সেই সুখানুভূতির তাড়নায় সে চালিত হয়। কিন্তু বাকি নফসগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে অর্গ্যান হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষের মনও একটি এবস্ট্রাক্ট বিষয়। কেননা বৈজ্ঞানিকভাবে মন কিছু কেমিক্যাল নিউরোট্রান্সমিটার, পাথওয়ে ও সার্কিটের সন্নিবেশ ছাড়া কিছুই নয়। নফসের গতি নিম্নমুখী। নফস শয়তানের প্ররোচনা ও দুনিয়ার মোহে নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে নামতে কার্পণ্য করে না। ৭ ধরণের নফস মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। যথা-
* নফসে আম্মারা (আদেশ দানকারী)
* নফসে লাউয়ামা (তিরস্কারকারী)
* নফসে মুলহিমা (ইলহামপ্রাপ্ত)
* নফসে মুতমাইন্না (প্রশান্ত)
* নফসে রাদিয়া (আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট)
* নফসে মারদিয়া (আল্লাহর কাছে প্রিয়)
* নফসে কামালিয়াত (পরিপূর্ণ)
মোদ্দাকথা, রূহ, কলব ও নফসকে মানবদেহের কোন অঙ্গ হিসেবে না নিয়ে মেটাফিজিক্স হিসেবেই নিতে হবে।
৪. ফিতরাত
প্রত্যেক মানুষ ইসলামের স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে সেই স্বভাব যদি পরিবার কিংবা সমাজের ভ্রান্ত বিশ্বাস দ্বারা দূষিত, বিচ্যুত বা প্রতিস্থাপিত না হয় তবে প্রত্যেকেই ইসলামের সত্যকে অনুধাবন করে তা সহজেই গ্রহণ করতে পারবে।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “প্রত্যেক মানবসন্তান ফিতরাত বা স্বভাবের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা মাজুসি (জরুথ্রস্ট বা অগ্নি উপাসক) হিসেবে গড়ে তোলে”।
তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল আল্লাহ তায়ালা একটি সুনির্দিষ্ট স্বভাব দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা হল ইসলামের স্বভাব। সেই মৌলিক স্বভাবের প্রতি লক্ষ্য রেখেই মহান আল্লাহ মানবজাতিকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “আমি কি তোমাদের রব নই? আমরা সমস্বরে জবাব দিয়েছিলাম, ‘হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই আমাদের রব’ ”। (৭:১৭২) ফিতরাত হলো মানব মনের জন্মগত সেই অবস্থা বা বৈশিষ্ট্য যা পরবর্তি সময়ের বিশ্বাস ও কার্যক্রম দ্বারা প্রভাবিত নয়, যা ইসলামের সত্যকে অকপটে স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। ইসলাম আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ বৈ কিছুই নয়। অন্য কারও নিঃশর্ত আনুগত্য করা যাবে না, এটিই হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রকৃত অর্থ।
এই বিশ্বাসের আলোকেই আল্লাহর নবি সা. বলেছেন, “প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাত বা পুতঃ স্বভাব নিয়েই জন্ম নেয়। যেমন চতুষ্পদ পশু নিখুঁত বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাদের মধ্যে কোন কানকাটা বা অঙ্গহানি দেখতে পাও? (বরং মানুষেরাই তার নাক, কান কেটে দিয়ে বা ছিদ্র করে তাকে বিকৃত করে থাকে।)” এভাবেই তিনি নিখুঁত দৈহিক অবয়বকে নির্মল হৃদয়ের সাথে তুলনা করেছেন। আর ত্রুটি হল তাই যা বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ করে। বিখ্যাত হাদিস সংকলক ‘ইমাম মুসলিম’ তাঁর সহিহ গ্রন্থে ‘আইয়াদ ইবনে হিমার’র বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহর রাসুল সা. হাদিসে কুদসিতে জানাচ্ছেন, আমি আমার বান্দাদেরকে আমার প্রতি অনুগত করেই সৃষ্টি করেছি, তারপর শয়তান তাদের কাছে এসে বিভ্রান্ত করে। আমি তাদের জন্য যা কিছু বৈধ করেছি, সে তা হারাম করে দেয় এমনকি আমার সাথে শরিক করতে বলে যে সম্পর্কে আমি কোন প্রমাণ পাঠাইনি”। ফিতরাত এবং সত্যের সম্পর্ক হল চোখ ও সূর্যের সম্পর্কের মতো। চক্ষুবিশিষ্ট প্রতিটি মানুষই সূর্যকে দেখতে পায় যদি না তার সামনে কোন আড়াল থাকে। ইহুদিবাদ, খ্রিস্টবাদ কিংবা জরুথ্রস্ট্রিয়ান ভ্রান্ত বিশ্বাস তাদের
জন্য সেই দেয়াল তৈরি করে যা তাদের সত্যকে অবগাহন করতে দেয় না। এটি খুবই সাধারণ অভিজ্ঞতা যে, যাদের জিহ্বার স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়নি তারা অবশ্যই মিষ্টি পছন্দ করবে। এটি খুবই স্বাভাবিক যে তারা কখনও মিষ্টান্নকে অপছন্দ করবে না যতক্ষণ তাদের জিহ্বার স্বাদ চলে না যায়।
যা হোক, মানুষ ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে বলতে মানুষ আসলে ইসলামের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জন্মায় না। এটি নিশ্চিত যে, আমরা যখন মায়ের জরায়ু থেকে বের হই আমরা তখন একেবারেই অবুঝ। বরং আমরা এমন একটি নির্মল হৃদয় নিয়ে জন্ম নিই যেটি সত্যকে মেনে নিতে তৈয়ার থাকে। যদি তার অন্তরে দূষণ বা খারাপ কিছুর মিশ্রণ না ঘটে তাহলে সে পরিণামে মুসলিম হয়ে বেড়ে ওঠে। এই যে সত্যকে জানা ও মেনে চলার চিরায়ত শক্তি এবং ক্ষমতা যা মানুষকে ইসলামের পথে আনে ও বেড়ে তোলে তাকেই ফিতরাত বলে। (ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া, ৪: ২৪৫-৭)
৫. আকল
আকল মোটাদাগে কলবেরই অংশ। মানুষের বিবেক-বুদ্ধিবৃত্তি, উন্নত চিন্তা-চৈতন্য, বিশ্বাস, যুক্তি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এগুলো আকলের অন্তর্ভুক্ত। কুর'আনে বারবার আকলকে ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা আকলকে কাজে লাগায় না তারা মুক-বধির (আনফাল ২২), আল্লাহ তাদের উপর ভুল চাপিয়ে দেন (ইউনুস ১০০)। আকলকে কাজে লাগালে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। নবিদের আনা হেদায়েত লাভ করা যায়। আকলের সদ্ব্যবহার না করার কারণে জাহান্নামীরা আফসোস করে বলবে- 'হায়! যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না (মুলক ১০)। সঠিক বা সম্পূরক শিক্ষা ও পরিবেশ পেলে আকল উৎকর্ষিত হয়ে কুর'আন-সুন্নাহর কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তবে সমান হয় না। আর বিপরীত শিক্ষা ও পরিবেশে অধঃপতিত হতে থাকে, তবে একদম নিঃশেষ হয়ে যায় না। যুক্তি সহায়ক তবে পর্যাপ্ত নয়। যুক্তি দুই ধরণের- নফসানি যুক্তি ও রব্বানী যুক্তি। নফসানি যুক্তি নিছক অনুমাননির্ভর। নফস দ্বারা প্রভাবিত। তাই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অতএব, রব্বানী যুক্তির চর্চা আমাদের বৃদ্ধি করতে হবে।
আত্মিক (কলবের) রোগ
কলব বা অন্তর রোগাক্রান্ত হলে এতে কালো দাগ পড়ে। কলব রোগাক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন- অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে থাকা (তাওবা, ৯৭)। অতিভোজন, অতিকথন, অতি দৃষ্টি প্রভৃতি। ইমাম তাইমিয়া কলবের রোগের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন- রইবা (সন্দেহ) ও শাক্কু (সংশয়), শুহহু ও হাওয়া (লালসা ও প্রবৃত্তির বাসনা) এবং জাহালত ও গোমরাত (অজ্ঞতা)। فِیْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ١ۙ 'তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি' আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ, কাতাদা প্রমুখ তাবেঈন কখনও কখনও ব্যভিচার বা পরনারী আসক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলে ফ্রয়েডের গবেষণাকে আংশিক সত্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়, কারণ ফ্রয়েড সমস্ত স্নায়ুবিক ক্লেশ ও মানসিক ব্যাধির কারণ হিসেবে যৌনতা ও এর ওপর আরোপিত সামাজিক, ধর্মীয় বিধি আরোপকে দায়ী করেছে। ইসলাম বলছে, অনিয়ন্ত্রিত, অবাধ যৌনতা বা যৌন লালসা অন্তরের রোগের একমাত্র কারণ নয় বরং অন্যতম কারণ। আবার ফ্রয়েডের দেয়া সমাধান মোটেও সঠিক নয়- "আমাদের কেবল সবরকম সংযম ও লজ্জাবোধের সাথে যৌন আচরণের ওপর আরোপিত সামাজিক বাধা-নিষেধ উৎখাত করা প্রয়োজন। তাহলে সমস্ত সুক্ষ্ম স্নায়ুবিক ক্লেশ ও মানসিক ব্যাধি আপনা আপনি দূর হয়ে যাবে"। ফ্রয়েডের কারণগত (Aetiological) উদঘাটন আংশিক সঠিক তবে পুরোধা নয়, কারণ মানসিক ব্যাধির একের অধিক কারণ (multiple aetiology) থাকে। আর কারণ উদঘাটন করলেও সমাধান উদ্ভট। সমাজ থেকে সংযম লজ্জাবোধ ও যৌন আচরণের সামাজিক বিধিনিষেধ তুলে দিলে এটি মানবিক নয় পাশবিক সমাজে পরিণত হবে। এটি তখন আর চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আধুনিকতাবাদের প্রজেক্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। কলবের রোগ ৫০টির অধিক। নিম্নে কিছু কলবের রোগের নাম উল্লেখ করা হল:
১. শিরক
৭. গীবত
১৩. প্রবৃত্তির অনুসরণ
১৯. কুধারণা
২৫. অবহেলা
৩১. সত্য থেকে মুখ ফেরানো
২. কুফর
৮. লোভ
১৪. বিদাতের অনুসরণ
২০. হিংসা
২৬. বক্রতা
৩২. কটুক্তি
৩. নিফাক
৯. মিথ্যা বলা
১৫. ক্রোধ
২১. উদাসীনতা
২৭. অন্তরের সংকীর্ণতা
৩৩. আত্মপ্রীতি
৪. জুলুম
১০. কৃপণতা
১৬. জাহালত বা মূর্খতা
২২. অতি ঘুম
২৮. অন্তরে মরিচা পড়া
৩৪. একদেশদর্শিতা
৫. অহংকার
১১. রিয়া
১৭. পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুসরণ
২৩. দ্বীনের ব্যাপারে চরমপন্থা বা প্রান্তিকতা
২৯. অন্তর মরে যাওয়া
৩৫. গোত্র বা স্বজন প্রীতি
৬. বিদ্বেষ
১২. ধোঁকা বা প্রতারণা
১৮. ভয়
২৪. হতাশাগ্রস্ততা
৩০. সত্যকে অস্বীকার
৩৬. অলসতা
আত্মার চিকিৎসা:
১. তাওবা ও ইসতিগফার (৬৬:৮)
২. সবর (২:১৫৫,১৫৬)
৩. সত্যের ওপর অটল থাকা (১১:১১২)
৪. শোকর করা (১৪:৭)
৫. তাওয়াক্কুল করা (৩: ১৫৯)
৬. খালেস ভাবে ইবাদত করা (৯৮:৫)
৭. ইহসান করা (২:১৯৫, ৫৫:৬০)
৮. আল্লাহকে ভয় করা (৩:১৭৫)
৯. আল্লাহর রহমতের আশা করা (২:২১৮)
১০. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসা (২:১৬৫)
১১. দুনিয়া বিমুখ হওয়া (৫৭:২০)
১২. অল্পে তুষ্টি (২২:৩৬)
১৩. আত্মসমর্পণ করা (২:৩১)
১৪. তাকদিরকে মেনে নেয়া (৮১:২৯)
১৫. মৃত্যুকে স্মরণ করা
১৬. দোয়া করা (৪০:৬০, ৬৫; ৭:২০৫)
১৭. বিনয় (১৭: ১০৯; ২৩:১,২)
১৮. কুরবানি করা (১০৮:২)
১৯. মানত করা (২২:২৯)
২০. আল্লাহমুখী হওয়া (৩১:১৫, ৩৯:১৭)
No comments