রব্বানী আত্মগঠন || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||


রব্বানী আত্মগঠন

বাপ্পা আজিজুল


আত্মগঠনের তিনটি দিক-

১. নিজেকে জানা; 

২. নিজেকে যাচাই করা

৩. নিজের উন্নয়ন ঘটানো


নিজেকে জানার অর্থ: মান আরাফা নাফসাহু, ফাক্বদ আরাফা রব্বাহু। যে নিজেকে চেনে, সে তার রবকে চেনে। সক্রেটিস এর ভাষায়- Know Thyself, সংস্কৃততে বলে 'আত্মানং বিদ্ধি'। আরও বলা যায়-  Self exacavation, self discovery.




আমি কে?

আমি শরীর (body), মন (mind) ও আত্মার (soul) যোগ। আমার চিন্তা (thought) এবং কর্মও (activities) আমি। আমার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও আমি। আমার শরীর রক্ত-মাংস-হাড়ের। মন সে তো কিছু রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আত্মা আধ্যাত্মিকতা (রুহ, নফস, কলবের সমন্বয়)। আমি মরে যাব। দেহ নষ্ট হয়ে যাবে। মন বিলীন হয়ে যাবে। আত্মা ফিরে যাবে। চিন্তা ও কর্ম বেঁচে থাকবে। আজকের আমি পুরোটাই অতীতের উপর প্রতিষ্ঠিত। অতীতে আছে অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি। বর্তমান কতিপয় অনুভূতি। ভবিষ্যৎ খুবই ক্ষীণ। কিছুই জানি না।

নিজেকে যাচাই করার অর্থ: আত্মসমালোচনা, মোহাসাবা। ইমাম গাজালি বর্ণিত আত্মোন্নয়নের ছয়টি উপায়ের একটি। নফসে লাউয়ামাহ নিজেকে সব সময় অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনার উপর রাখে।

নিজের উন্নয়ন বলতে আরও তিনটি কথা: 

ক) উচ্চ অবস্থানে যাওয়া

খ) পরবর্তী ধাপে পৌঁছা

গ) সমস্যা/সংকটের উত্তরণ 



চিত্র: জো-হারি'র উইন্ডো

মনোবিদ্যায় জো-হারি'র জানালা নিজের অমিত সম্ভাবনা, পারস্পরিক অর্থপূর্ণ যোগাযোগের দক্ষতা তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আমরা উপর্যুক্ত নমুনাটি ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করব। জো-হারি'র জানালায় ৪টি খোপ রয়েছে। a. উন্মুক্ত অঞ্চল b. গোপন অঞ্চল c.  অস্পষ্ট অঞ্চল d. অজ্ঞাত অঞ্চল। 

উন্মুক্ত অঞ্চল- যেটি ব্যক্তির জানা, অন্যরাও সেটি জানে। এটি ব্যক্তির মুয়ামেলাত যা অন্যের সামনে প্রকাশ পায়। ব্যক্তি এখানে সচেতন থাকে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে বা রাখতে চায়। ব্যক্তির সামাজিক, সামষ্টিক কর্তব্য, দায়িত্ব পালন, ইবাদত এখানে শামিল হয়। হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ উভয়ই এখানে পালিত বা লংঘিত হতে পারে। এখানে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা তৈরি হতে পারে। উন্মুক্ত অঞ্চলের কার্যক্রম বা মুয়ামেলাত দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ব্যক্তিকে সবসময় যাচাই বা বিচার করা যায় না। মানুষের তিরস্কার, পুরস্কার, ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধান ব্যক্তির আচরণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।

গোপন অঞ্চল- গোপন অঞ্চলে ব্যক্তির একান্ত কিছু আমল থাকে। ভালো কিংবা মন্দ। যা সে নিজেই শুধু জানে। বাহিরের কেউ জানে না। কোন গোপন পাপ সংঘটিত হলে কায়মনোবাক্যে তাওবা করলে কবুল হয়। তাহাজ্জুদ, গোপন দান বা গোপন/নফল ইবাদাতের কারণে ব্যক্তির মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানে নফস প্রতিনিয়ত জিহাদে লিপ্ত থাকে। এই অঞ্চলটি হচ্ছে আল্লাহ ও বান্দার একান্ত অঞ্চল। উভয়মুখী ও সরাসরি।  

অস্পষ্ট অঞ্চল- এই অঞ্চল সম্পর্কে ব্যক্তির নিজের ধারণা থাকে না। ব্যক্তির সদগুণ বা দূর্বলতা, সক্ষমতা (Potentiality)। বাহ্যত একজন মানুষ ক্রমাগত নিজের খারাপ কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু তার মৌলিক মানবীয় কিছু ভালো গুণ আছে। সেটিকে পরিচর্যা করলে তার উপর ইসলামি নৈতিকতার সৌধ বিনির্মাণ করা সম্ভব। অথবা একজন মুমিন যিনি গড়পড়তা আমল করেন কিন্তু তার মধ্যে ইখলাসকে পয়দা করতে পারলে, হিকমতকে জুড়ে দিতে পারলে তিনি আরও উচ্চতর পর্যায়ে যেতে পারেন। এই অঞ্চল নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দাঈদের, ওস্তাদের, ইসলামি মেন্টর/কাউন্সেলরদের। আল্লাহ'র রাসুল, সাহাবি আজমাঈন এই কাজটি করতেন। যেমন- রাসুল সা. একবার আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বলেছিলেন, আবদুল্লাহ খুব ভালো লোক যদি সে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ত! আবার একবার তাহাজ্জুদের নামাযের কিরাআত শুনে রাসুলুল্লাহ সা. আবু বকর রা. কে বলেছিলেন, তোমার তিলাওয়াতের আওয়াজ একটু বাড়িয়ে দিও; উমার রা.কে বলেছিলেন তোমার তিলাওয়াতের আওয়াজ একটু কমিয়ে দিও। বান্দা তখন অন্যের সহযোগিতায় নিজের অজানাকে জানার চেষ্টা করে।  

অজ্ঞাত অঞ্চল- ব্যক্তির অজ্ঞাত অঞ্চল সম্পর্কে ব্যক্তি বা অন্য কেউ কিচ্ছু জানে না। জানেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানা। অন্য অঞ্চল সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা সম্যক অবগত। এই অঞ্চল ব্যক্তির তাকদির, আল্লাহর রহমত, বরকত, কুদরত, নিয়ামত, আজিমতের অঞ্চল। এই অঞ্চলে বান্দা নিজেকে এবং আল্লাহকে তালাশ করতে থাকে। সঠিক ও সহিহ পদ্ধতিতে তালাশ করলে আল্লাহর হাত তার হাত হয়ে যায়। এই অঞ্চলে কাজ করা ও নিজের দখল বাড়ানোর নাম তাযকিয়া। 


তাযকিয়ায়ে নফস

তাযকিয়া শব্দের অর্থ পবিত্র বা পরিশুদ্ধ করা, প্রবৃদ্ধি হওয়া। তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মার পরিশুদ্ধি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তি তার নফসকে শিরক-বিদাত ও অন্যান্য পাপাচারসহ সমস্ত ধরণের কলুষতাপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা এবং উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে নিজেকে সজ্জিত করাকে তাযকিয়ায়ে নফস বলে। তাযকিয়ার সারকথা হল- সমস্ত গাইরুল্লাহকে বর্জন করে কেবল আল্লাহকে গ্রহণ করে সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এতে কোন কোন ভায়া বা মাধ্যম নেই। তাযকিয়ার এই চূড়ান্ত উদ্দেশ্যেই হচ্ছে ইহসান যা নৈতিকতার সর্বোচ্চ শিখর। এটিই ইখলাস যা দোয়া কবুলের প্রথম শর্ত। নবি-রাসুলদের আঞ্জাম দেয়া ৪টি প্রধান কাজের একটি তাযকিয়া। এই বিষয়ে নানা মত, তত্ত্ব, উপায় এযাবৎ আলোচিত হয়েছে। প্রথম যুগের সালাফদের পাশাপাশি উত্তরকালে আল কিন্দি, ইবনে সিনা, ইমাম গাজালি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়িম প্রমুখ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। শত শত কিতাবাদি রচিত হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে রূহ, নফস ও কলবের গতিশীল আন্তঃক্রিয়ার একটি নমুনা নিচে চিত্র সহকারে দেখানো হল-



উপরোক্ত মডেল অনুসারে, মানুষের আত্মা জন্মগতভাবে বিশুদ্ধ এবং সৎ প্রকৃতির। এটিকে ফিতরাত বলা হয় যা আল্লাহ তায়ালার কাছে থেকে আগত এবং তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু আল্লাহ সেটির উপর আড়াল তৈরি করে দিয়েছেন এবং দুনিয়ার জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে সেটিকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে পুরো জীবনব্যাপী এবং সার্বক্ষণিক  আত্মার (এই আত্মার চারটি প্রধান উপাদান- রূহ, নফস, কলব, আকল) মধ্যে বিভিন্ন ধরণের দ্বান্দ্বিক বলের একটি গতিশীল পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এর ফলে ব্যক্তির মনোজাগতিক অবস্থার বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে যার কারণে ফিতরাতের সাথে আত্মার সমরৈখিক বা অসমতলীয় অবস্থানের সৃষ্টি হয়। নফসের দোদুল্যমান অবস্থাকে বলা হচ্ছে নফসে লাউয়ামা। এসময় নফস মন্দকাজ করার পরে অনুশোচনায় ভুগে। কেননা যে শয়তানের প্ররোচনায় মন্দকাজে লিপ্ত হয়েছিল সে ঐ ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করে। ব্যক্তির এহেন ভালো-মন্দ মিশেলে গঠিত চরিত্রকে বলা হয় তাহযিবুল আখলাক। নমুনা চিত্রে বিষয়টি বেগুনি রঙ এ দেখানো হয়েছে। 



কলব হল মানুষের আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র যার মধ্যে আকল বা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাও অন্তর্নিহিত রয়েছে। যা চাইলে ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুটি দিকেই চলৎশক্তি সম্পন্ন। দুনিয়া ও শয়তানের প্রভাবে যদি নফসের খায়েশে নিম্নগামী হয় এবং ফিতরাত থেকে দূরগামী হয়, তাহলে তার মধ্যে নেতিবাচক গুণাবলী ও আচরণ (মুহলিকাত) প্রবল হয়ে ওঠে এবং একটি গাফলতির অবস্থা সৃষ্টি হয়। নফসের এই অবস্থাকে নফসে আম্মারা বিল সু বলা হয়। যা নমুনা চিত্রে লাল রঙে (মুমিনের জন্য বর্জনীয়) হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। 



অন্যদিকে, কলব (আকলসহ) আবার উর্ধ্বগামীও হতে পারে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভয় ও আখিরাতের স্মরণ মানুষের কলবকে খোদাভীরু রুহের গুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। ফলে মানুষেত মধ্যে বাঞ্ছিত, ইতিবাচক গুণের (মুনজিয়াত) উন্মেষ ঘটে। এবং আত্মা তখন ফিতরাতের সাথে অধিকতর সমরৈখিক অবস্থানে উপনীত হয়। নফসের এই অবস্থাকে নফসে মুতমাইন্নাহও বলা হয়। যা নমুনা চিত্রে নীল রঙে চিত্রায়িত হয়েছে। 



নফসে আম্মারা থেকে নফসে লাউয়ামাতে উত্তীর্ণ হওয়ার নিরন্তর সংগ্রামকে বলা হয় জিহাদুন নফস যেটিকে বড় জিহাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইবনুল কাইয়্যিম জিহাদুন নফসের ৪টি পর্যায় ব্যক্ত করেছেন, ১. দ্বীন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানার্জন। কেননা, ইসলাম দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়গুলোকে ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতিতে ফোকাস করেছে; ২. জ্ঞানার্জনের ভিত্তিতে বাস্তব অনুশীলন; ৩. অর্জিত জ্ঞানকে দাওয়াহ'র মাধ্যমে প্রচার-প্রসার করা; ৪. দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্মুখীন হলে সবরের মাধ্যমে বিশ্বাস ও কর্মে ইস্তিকামাত থাকা। আশা করা যায় জিহাদুন নফসের ৪টি পর্যায় অতিক্রম করে একজন মুসলিম রব্বানী দলে প্রবেশ করতে পারবে। নফসে লাউয়ামা থেকে নফসে মুতমাইন্নাহতে উত্তীর্ণ হওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার নাম তাজকিয়াতুন নফস। আবার আচরণ বা চারিত্রিক বিচারে আখলাকে যামীমা বা বর্জনীয় চরিত্র (মুহলিকাত) থেকে তাহযিবুল আখলাকে উত্তরণ হল নফসের জিহাদ এবং সেখান থেকে মুনজিয়াত বা আখলাকে হামিদার অনুশীলনকে বলা হয় তাযকিয়ায়ে নফস। 

এতক্ষণ তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি বা অন্তরের রোগের চিকিৎসার ভিত্তিমূলক জ্ঞান, তথ্য, তত্ত্ব ও নমুনাচিত্র আমরা জানতে পারলাম। অনুধাবন করতে পারলাম। রমাদান মাস তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। কেননা- রমাদান তাকওয়ার মাস। রমাদান কুর'আন নাযিলের মাস। রমাদান জিহাদের মাস। রমাদান জ্ঞানার্জনের মাস। রমাদান আত্মসমর্পণের মাস। রমাদান আত্মসংযমের মাস। রমাদান আত্মসমালোচনার মাস। রমাদান বেশি বেশি নফল ইবাদাতের মাস। সিয়াম, কিয়াম, ইতিকাফের মাস। এই মাসে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে থাকে। নফসের উপর তার প্ররোচনা কম থাকে। মানুষের অন্তর নরম থাকে। সে অনুতপ্ত হয়। ভালো কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মন্দকাজের উৎসগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয় ফলে গাফলতিতে পড়ে থাকা ব্যক্তির চৈতন্যের উদয় হয়। তাওবা করে মুহলিকাত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। আল্লাহ ভীতি ও পরকালের চিন্তা প্রকট হয়ে উঠে। মানুষ ফরজ তরকের প্রতি আপোস করে না। নফল আদায়ে সচেষ্ট হয়। নফস- লাউয়ামা অবস্থান থেকে মুতমাইন্নাহতে শিফট করতে থাকে। তাহযিবুল আখলাক, মুনজিয়াতে রূপান্তরিত হতে থাকে। রূহ খোরাক পেতে থাকে। কলব ও আকল ফিতরাতের বৈশিষ্ট্যের সাথে একাত্ম হয়ে উঠে। একজন মুমিন তখন আত্মশুদ্ধির পথে এগোতে থাকে। 

ইমাম গাজালি তাঁর 'এহইয়া উলুমুদ্দীন' গ্রন্থে  আত্মশুদ্ধির জন্য ৬টি কাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।

১. মুশারাতা; নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নিজের সাথে চুক্তি করা। 

২. মুরাকাবা; রক্ষা করা বা পাহারা দেয়া। নিজের আমলের সংরক্ষণ করা, নিজেকে নিজে পাহারা দিয়ে নফস ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করা। 

৩. মুহাসাবা; আত্মসমালোচনা করা। নিজের জীবন ও কর্মের প্রতি সব সময় সমালোচনার দৃষ্টি রাখা। সংশোধন হওয়া।

৪. মু'আকাবা; নিজেকে শাস্তি দেয়া। নিজের সাথে কৃত চুক্তি পূরণে ব্যর্থ হলে নফল রোযা, সালাত, সাদাকার মাধ্যমে নফসকে শাস্তি দেয়া। 

৫. মুজাহাদা; নফসের খায়েশের বিরুদ্ধে সর্বাবস্থায় নিরন্তর জিহাদ বা সংগ্রাম করা।

৬. মুয়াতাবা; সর্বদা তাওবা ও অনুশোচনার হালতে থাকা। মন্দকাজ করলে কালবিলম্ব না করে আল্লাহ তায়ালার কাছে ভুল স্বীকার করে তাওবা করতে হবে। পুনরায় সেটি না করার সংকল্প করতে হবে। 

পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং: এটি  দুধরণের হতে পারে। আত্মপর্যবেক্ষণ (Self monitoring) বা অন্যের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা (Monitoring by mentors)। মুমিন সর্বদা আল্লাহ তায়ালার পর্যবেক্ষণে থাকে। এই চেতনা জাগ্রত রাখতে হবে। "অবশ্যই তোমাদের উপর নিযুক্ত আছে তত্ত্বাবধায়কেরা" (ইনফিতার ১০)। তবে ইসলামে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুমিনের আত্মিক উন্নতি ও পর্যবেক্ষণের জন্য একজন মেন্টর খুব জরুরি। দ্বীন শেখা ও প্রচারের জন্য সালাফদের সময় থেকেই এই রেওয়াজ আছে। রাসুলুল্লাহ সা. গভীর রাতে সাহাবিদের কিয়ামুল লাইল ও কুর'আন তিলাওয়াত পর্যবেক্ষণ করতেন এবং ফজরের পরে তাদের নসিহত করতেন। পরিবারের প্রধান যেহেতু মুত্তাকি সদস্যদের ইমাম (ফুরকান ৭৪) বা মেন্টর, তিনিও পরিবারের অন্দরে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। একটি দৈনিক রিপোর্টিং সিস্টেম থাকতে পারে। ব্যক্তিগত রিপোর্ট পদ্ধতি আধুনিককালের হলেও এর স্পিরিট কুর'আন-হাদিস উৎসারিত। মনোরোগের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসায় দৈনিক রিপোর্ট সংরক্ষণ ও মনিটরিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন উপসর্গ ট্র‍্যাক করা হয়।  দৈনিক রিপোর্টের মাধ্যমে ব্যক্তি Self monitoring করতে পারে। অথবা দৈনিক কাজ বা পরিকল্পনার চেকলিস্ট থাকতে পারে। যেটি দেখে আপনি নিজেকে মনিটরিং করবেন। কাজ সম্পাদন হলে স্টার মার্ক (*) দেবেন। এই আত্মপর্যবেক্ষণ আত্মিক উন্নতির জন্য জরুরি। 

যাচাই: সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল আত্মযাচাই বা Self evaluation. ইমাম গাজালি যাকে মোহাসাবা বলেছেন। দিনের অন্তে নিজেকে একান্তে কিছু সময় মোহাসাবার জন্য রাখতে হবে। কারণ "তোমার কাছে হিসাব চাওয়ার আগে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার আগে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও"  (তিরমিজি, ৬৩)। নিজের কাজ মূল্যায়ন করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আশানুরূপ ফলাফলে মাঝেমধ্যে নিজেকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে (Self reward)। আবার গুনাহের কাজ হয়ে গেলে নফল রোজা বা সাদাকার মাধ্যমে মু'আকাবা (Self punishment)করা যেতে পারে। 

আধুনিক মনোচিকিৎসার অংশ হিসেবে সাইকোথেরাপিতে বিভিন্ন ধরণের বিহ্যাভিয়ারাল টেকনিকস অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে self control techniques এবং contingency management উল্লেখযোগ্য। ইমাম গাজালির দেয়া উপায়গুলোর সাথে এই টেকনিকসগুলো অধিক সংগতিপূর্ণ। একজন রব্বানী আত্মগঠনের জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়গুলোকে কাজে লাগাবেন। 

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.