শরিয়াহ হাসপাতালের ধারণা || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||
শরিয়াহ হাসপাতালের ধারণা
বাপ্পা আজিজুল
ভূমিকা
ওহি নির্দেশিত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের একটি নিজস্ব বিশ্ববীক্ষা আছে। যেহেতু মানবজাতিকে দুনিয়া আবাদ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, মানুষ দুনিয়া আবাদ করবে ইবাদতের দ্বারা, অন্যের কল্যাণের মাধ্যমে, মহান রবের প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। মানুষের একাজ মসৃণভাবে পালনের লক্ষ্যে আরও পাঠানো হয়েছে নবি-রাসুল ও পথনির্দেশিকা। মানুষসহ জমিনের ওপর বিচরণরত প্রতিটি প্রাণীর জন্য রয়েছে রিজিকের ব্যবস্থা। মানুষের সুবিধার্থে অনুগত করা হয়েছে পরিবেশ, প্রাণীকুল ও নানাবিধ উপকরণ। দায়িত্ব হল দ্বীন পরিপালন ও প্রতিষ্ঠা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইবাদত ও মুয়ামেলাতের মাধ্যমে দ্বীন সহজ ও শুদ্ধভাবে পরিপালনের জন্য প্রণীত নীতিমালাকে শরিয়াহ বলে। ইসলামি শরিয়াহ আইন হিসেবে নির্ভুল, প্রত্যাদিষ্ট, সর্বজনীন, সম্পূর্ণ, বাস্তবসম্মত ও সমকালীন এবং দুনিয়া-পরকাল উভয় জগতের জন্য কল্যাণমুখী। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে শরিয়াহ মোটাদাগে ৫ টি মাকাসিদ বা উদ্দেশ্য হাসিল করে- দ্বীনের সুরক্ষা, জীবনের সুরক্ষা, আকলের সুরক্ষা, বংশধারার সুরক্ষা, সম্পদ ও সম্ভ্রমের সুরক্ষা। শরিয়াহ'র চূড়ান্ত লক্ষ্য উভয় জগতে মানবজাতির প্রভূত কল্যাণ সাধন করা। দুনিয়ার কল্যাণার্থে শরিয়াহ মুয়ামেলাত (আখলাক), আখিরাতের কল্যাণের জন্য আকিদা ও ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষের চাহিদার মধ্যে কিছু রয়েছে জরুরিয়াত (Primary needs), কিছু হাজিয়াত (Secondary needs), কিছু তাহসিনিয়াত বা কামালিয়াত (Tertiary needs)। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা জরুরিয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
শরিয়াহ হাসপাতাল (Shariah compliant hospital) কী?
শরিয়াহ হাসপাতাল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা পলিসি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, স্টাফ পরিচালনা, কর্মক্ষেত্র ও সেবা কার্যক্রমে সামগ্রিকভাবে শরিয়াহ নীতি অনুসরণ করে। শরিয়াহ হাসপাতাল বলতে চিরায়ত হাসপাতালের মধ্যে কেবল কিছু ইসলামি মূল্যবোধ, উপাদান, হালাল উপকরণ ঢুকিয়ে দেয়া বা চর্চা নয় বরং এটি আগাগোড়া একটি নতুন ধারণা ও ব্যবস্থাপনার বিকাশ ও বাস্তবায়ন। শরিয়াহ হাসপাতাল মানে কেবল চ্যারিটি কিংবা অতি মুনাফালোভী নয়, বরং জনগণের প্রত্যাশা কেন্দ্রিক (people centered) ও সমস্যা (need based) সমাধানে সচেষ্ট। শরিয়াহ'র সুফল ও কল্যাণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। শরিয়াহ হাসপাতাল নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জাতীয় কিংবা স্থানীয় শরিয়াহ কাউন্সিল থেকে অনুমোদিত ও সনদ প্রাপ্ত হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে আবার সনদের জন্য আবেদন করবে। শরিয়াহ কাউন্সিল হাসপাতালটিকে সর্বদা মনিটরিং করবে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভিজিট ও শরিয়াহ অডিট করবে। শরিয়াহ'র শর্তসমূহ পরিপালিত হলে সনদ বহাল থাকবে, নবায়ন হবে। ব্যর্থ হলে শরিয়াহ স্ট্যাটাস রহিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ একবার শরিয়াহ অনুমোদন আজীবনের জন্য ঢাল হবে না।
অর্গানোগ্রাম
হাসপাতালের ধরণ ও বেড সংখ্যানুযায়ী দেশের প্রচলিত স্বাস্থ্যনীতি অনুসারে স্বাভাবিক অর্গানোগ্রাম ও জনশক্তির পাশাপাশি শরিয়াহ পরিপালনের জন্য নিম্নোক্ত অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা যেতে পারে।
১. শরিয়াহ বোর্ড (ন্যুনতম ৩ জন)
- চেয়ারম্যান
- সদস্য (২ জন)
যোগ্যতা: মেডিকেল ও ফিন্যান্স বিষয়ক শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ (পিএইচডি/মাস্টার্স/ইফতা/স্ব-শিক্ষিত)
২. শরিয়াহ এক্সিকিউশন কমিটি
- হাসপাতালের চেয়ারম্যান
- এমডি
- ডিরেক্টর (শরিয়াহ)
- শরিয়াহ এক্সিকিউশন অফিসার (SEO)
- এসিস্টেন্ট SEO
৩. শরিয়াহ মনিটরিং সেল
- ডিরেক্টর (শরিয়াহ)
- শরিয়াহ এক্সিকিউশন অফিসার (SEO)
- এসিস্টেন্ট SEO
(দৈনিক পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করবেন)
শরিয়াহ হাসপাতালের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
১. শরিয়াহ'র উদ্দেশ্য পরিপালনে বদ্ধ পরিকর।
২. বিনিয়োগ ও ব্যাবসায়ে শতভাগ হালালের নিশ্চয়তা।
• বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেক অংশীদারের হালাল উপার্জনের অংগীকারনামা গ্রহণ। এব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ খোঁজ নেবে। সতর্কতা অবলম্বন করবে।
• ইসলামি অর্থনীতির যৌথ অংশীদারিত্ব কারবারের নিয়মানুযায়ী পরিচালিত হবে।
• ঋণ গ্রহণ ও নৈমিত্তিক লেনদেনের প্রয়োজনে দেশে বিদ্যমান ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেটি শরিয়াহ পরিপালনে সবচেয়ে অগ্রসর, সেটিকে প্রাধান্য দেবে।
• কোন ধরণের (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) সুদ, ঘুষ, উৎকোচ, কমিশন ইত্যাদির লেনদেন করবে না।
• কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অধিকার ও অন্যান্য সুবিধাদিতে ইনসাফ নীতি গ্রহণ করবে।
• রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ে ইহসানের নীতি পালন করবে। (সকল পরীক্ষায় ৩০%, ভর্তি রোগী, ঔষধ ও অপারেশনে ১০% ছাড় দেয়া যেতে পারে।)
• দুঃস্থ রোগীর সহায়তায় যাকাত ও সাদাকা ফান্ড তৈরি।
• নিয়মিত অন্তঃ ও বহিঃ অডিটের মাধ্যমে আয়-ব্যয় ও লভ্যাংশের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৩. ইবাদত পালনে সহায়তা
- প্রতিটি ফ্লোরে নারী-পুরুষের পৃথক নামাজের নির্ধারিত স্থান নির্মাণ করা
- সুযোগ্য ইমামের মাধ্যমে ৫ ওয়াক্ত নামাজের প্রতিষ্ঠা
- উন্নত সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতি ফ্লোরে আযান ও নামাজের তিলাওয়াত পৌঁছে দেয়া
- প্রতিটি ওয়ার্ড ও কেবিনে কিবলার দিক নির্দেশনা রাখা
- প্রতিটি বেড ও কেবিনের জন্য ড্রয়ারে কুর'আনের কপি, হাদিস, সিরাত ও ইসলামি বই-পুস্তক রাখা।
- প্রতিদিন আসর কিংবা মাগরিবের পরে প্রত্যেক রোগীর কাছে 'প্রেয়ার টিম' ভিজিট করবে। তারা রোগীর খোঁজখবর নেবে, ইবাদাত পালনে উদ্বুদ্ধ করবে, রোগীর পবিত্রতা, নামাজ, অন্যান্য করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় মাসায়েল জানাবে, রোগীর জন্য দু'আ করবে, দু'আ চাইবে। প্রেয়ার টিমের নেতৃত্ব দেবেন ইমাম সাহেব।
- রোগীকে সেবা করা ইবাদত, হাসপাতালের সর্বত্র এই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটানো।
৪. ইজ্জত ও আব্রুর সংরক্ষণ
- নারী-পুরুষের এর জন্য পৃথক ওয়ার্ড, কেবিন, সিঁড়ি, লিফট একদম পরিকল্পিতভাবে শুরু থেকেই নির্মাণ করতে হবে।
- নারীদের জন্য দক্ষ নারী চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফ নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞ নারী চিকিৎসকের অপ্রতুলতা থাকলে শরিয়াহ মেনে পুরুষ চিকিৎসক যথাযথ সেবা দিতে পারেন। ভাইস ভার্সা।
- রোগীর সম্মান, প্রাইভেসিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া।
৫. জীবন ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা
- সর্বাধুনিক ও হালনাগাদ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা
- রোগীর ভোগান্তি কমাতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা
- চিকিৎসকসহ সকল স্টাফদের শরিয়াহ ও ইসলামে রোগীর মর্যাদা, অধিকার, নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা, প্রশিক্ষণ দেয়া ও নিজেদের স্বত:স্ফূর্ত ইসলাম পালনে উদ্বুদ্ধ করা।
- চিকিৎসক ও স্টাফদের মেডিকেল ফিকহ, ইথিক্স, বিহ্যাভিয়ারাল সায়েন্স ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা
- চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর বেস্ট ইন্টারেস্টকে অগ্রাধিকার দেয়া।
- রোগীর জন্য শরিয়াহ সম্মত হালাল ঔষধ, খাবার (পুষ্টিকর) ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা।
- রোগী ব্যবস্থাপনায় ইসলামি মুয়ামেলাত ও আদবের বহি:প্রকাশ ঘটানো। কাউন্সেলিংকে গুরুত্ব দেয়া।
- রোগীর ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা
৬. হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা
- হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়, জাতীয় ও শরিয়াহ'র সকল নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ করা
- কোনো ক্ষেত্রে ন্যুনতম প্রতারণা, ফাঁকি, দুর্নীতি, অবহেলা কিংবা অসততার আশ্রয় না নেয়া।
- রোগীকে অতিথি জ্ঞান করা।
- কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিত করা।
- পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ ও বর্জ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বারোপ করা।
- রোগী পক্ষের অভিযোগ, পরামর্শ ও ফিডব্যাক আমলে নেয়া।
- এভিডেন্স বেইজড প্র্যাক্টিস ও গবেষণার প্রতি বিশেষ জোর দেয়া।
শেষকথা
বাংলাদেশে যেহেতু জাতীয় বা স্থানীয় শরিয়াহ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত নাই, তাই শরিয়াহ হাসপাতাল নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ড গঠন করে শরিয়াহ মোতাবেক কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারে। তবে হাসপাতালের গুণগত মান ও শরিয়াহ অনুসরণে কোন ধরণের শিথিলতা কাম্য নয়। ডাটা সংরক্ষণের মাধ্যমে শরিয়াহ হাসপাতালের সকল কার্যক্রমকে প্রামাণ্য করতে হবে। দেশি-বিদেশী জার্নালে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশ করতে হবে। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতে পরিচালিত শরিয়াহ হাসপাতালের অভিজ্ঞতা ও রিসোর্স কাজে লাগানো যেতে পারে। সুন্দর পরিবেশ, মান সম্মত সেবার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জনগণ কিংবা সমাজ, রাষ্ট্রে প্রচলিত শরিয়াহ ভীতি কাটানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
No comments