নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||


 ছবি: সংগৃহীত
 নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত: ধারণা ও ইশতেহার প্রস্তাবনা 

বাপ্পা আজিজুল 

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান একটি উত্তর আধুনিক ফেনোমেনন। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হবে এই নিয়ে চলছে বিস্তর আলাপ। রাতারাতি ভূঁইফোড় অনেক প্ল্যাটফর্ম, কমিটি, সংগঠন, ব্যক্তিবর্গ দাঁড়িয়ে গেছে এই আলাপ ও বিতর্কে। ৩৬ জুলাই পরবর্তী দেশে ৩৬ টি নতুন রাজনৈতিক দল/অরাজনৈতিক সংগঠন/প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলেও কেউ নয়া বন্দোবস্তের সামগ্রিক ও কনক্রিট ধারণা এখনও হাজির করতে সক্ষম হয়নি। কেউ কেউ কালেভদ্রে দু-চারটে তত্ত্ব কপচালেও তাদের রাজনৈতিক বডি ল্যাংগুয়েজের সাথে তত্ত্ব গরহাজির। ফলে বৈষম্য বিরোধিতা, দায় ও দরদের রাজনীতির বউনি এখনও হয়নি বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, পতিত ফ্যাসিবাদেরই দোসর কেউ কেউ পুরনো বুলি নতুন বোতলে গেলানোর চেষ্টা করছেন। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার- তাদের মেটান্যারেটিভ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সাহিত্যে তারা লালন করে আধুনিকতাবাদ, ধর্মের প্রশ্নে অবস্থান ইসলামফোব সেক্যুলার, দর্শনে দ্বান্দ্বিক জড়বাদ ও বস্তুবাদ, অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ/মার্কসবাদ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় উগ্র একাত্তরবাদ। এইগুলো একটা আরেকটার সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। এই বাদগুলোকে (ইজম) বাদ দিতে হবে বস্তুনিষ্ঠ ও শক্তিশালী বাদ দিয়েই। ইতিহাস, দর্শন ও ভূ-রাজনীতির আলোকে আমাদের তৈরি করতে হবে একাধিক ন্যারেটিভ। যার পাটাতন হবে বাংলাদেশী মুসলিম জাতীয়তাবাদ, উত্তর আধুনিকতা, উত্তর ঔপনিবেশিকতা, মধ্যমপন্থী সমন্বয়বাদ ও পালনবাদ। এছাড়া সমকালীন সময়কে ধারণ করতে হবে।সমকালীন সময়কে  সংজ্ঞায়িত করতে হলে  উত্তর ফ্যাসিবাদ, উত্তর আধুনিকতা, উত্তর সত্যযুগ, উত্তর সন্ত্রাসবাদ এবং চতুর্থ বিপ্লব পরবর্তী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সময়কে আমলে নিতে হবে। উত্তর আধুনিক রাজনীতি (Postmodern Politics) মূলত আধুনিকতার (Modernism) যুক্তিসর্বস্ব, সার্বজনীন সত্যকে উপেক্ষা, অবক্ষয় ও বিশ্ববীক্ষা ধারণার বিরোধিতা করে। এটি অধিকতর বৈচিত্র্যময়, সাংস্কৃতিকভাবে আপেক্ষিক, ধর্মসহিষ্ণু, দেশ-কাল-ঐতিহ্য এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—

১. আপেক্ষিকতা ও বহুমাত্রিকতা
আধুনিক রাজনীতিতে অধিবয়ানের (Grand/Meta Narratives) ওপর জোর দেওয়া হয় (যেমন- একাত্তর) , কিন্তু উত্তর আধুনিক রাজনীতি সত্যকে আপেক্ষিক (Relative) ও বহুস্তরবিশিষ্ট বলে মনে করে। টুকরো টুকরো অনেক ন্যারেটিভ বা বয়ান নির্মাণ করে ও সেগুলো নিয়ে কাজ করে। অধিবয়ানকে ভেঙে দেয়। কাউন্টার করে। রিফিউট করে। 

২. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ওপর গড়ে ওঠে, কিন্তু উত্তর আধুনিক রাজনীতি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে সমর্থন করে এবং স্থানীয় ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দাবিকে গুরুত্ব দেয়। কেন্দ্র ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাইনারি ধারণাকে ভেঙে দেয়। সাব অল্টার্নকে প্রাধান্য দেয়। 

৩. পরিচয়ের বহুমুখিতা
জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং যৌন পরিচয়ের ক্ষেত্রে একক শ্রেণিবিন্যাসের পরিবর্তে বহুপরিচয়ের (Multiple Identities) ওপর গুরুত্ব দেয়। প্লুরালিজমকে ফোকাস করে। সেক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে প্লুরালিজমকে ডিফাইন করতে হবে। 

৪. মেটান্যারেটিভের (Metanarrative) বিরোধিতা
উত্তর আধুনিকতা বড়ো গল্প বা আদর্শিক কাঠামোগত ব্যাখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং স্থানিক বা ক্ষুদ্র (Local) গল্প ও অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

৫. গ্লোবালাইজেশন ও লোকালাইজেশনের সংমিশ্রণ
এটি বিশ্বায়নের (Globalization) পাশাপাশি স্থানিক (Localization) রাজনীতিকেও গুরুত্ব দেয়, যার ফলে গ্লোকাল (Glocal) রাজনীতির ধারণা তৈরি হয়।

৬. মুক্তবাজার ও প্রযুক্তির ভূমিকা
উত্তর আধুনিক রাজনীতি তথ্যপ্রযুক্তি, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকাকে স্বীকার করে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে। যেহেতু আমরা ৪র্থ শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ন্যানো টেকনোলজির যুগে বসবাস করছি। 

৭. আবেগ ও সংস্কৃতির গুরুত্ব
যুক্তিবাদী রাজনীতির পরিবর্তে আবেগ, অনুভূতি ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে। উত্তর আধুনিক রাজনীতি মূলত আধুনিকতার কাঠামোবদ্ধ, এককেন্দ্রিক ও সার্বজনীন চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে আরও বহুমাত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বিকল্প চিন্তার জন্য উন্মুক্ত একটি রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

৮. ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল
উত্তর আধুনিকতা ও উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তার অবস্থান থেকে ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদার অবস্থান গ্রহণ।

দলের কাঠামো
উত্তর আধুনিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের গঠন কাঠামো হতে পারে বিকল্পধারার, বিকেন্দ্রীভূত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর। নিচে এমন একটি রাজনৈতিক দলের কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো—

১. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব: কোনো একক নেতার পরিবর্তে সমষ্টিগত নেতৃত্ব বা "কালেক্টিভ লিডারশিপ" মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
স্থানীয় কমিটি: তৃণমূলের জনগণ যাতে সরাসরি নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে পারে, সেজন্য প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।
অনলাইন গণভোট: বড় সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে দলীয় কর্মী ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গণভোটের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

২. পরিচয়ের বহুমুখিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি
নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ: এই দলকে এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে নারী, আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে।
বয়সভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণ: তরুণ ও প্রবীণদের সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কোটা বা পারস্পরিক পরামর্শ কাঠামো থাকতে হবে।
৩. নীতি-নির্ধারণে মেটান্যারেটিভের বিরোধিতা ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান
আদর্শিক কঠোরতা নয়, বাস্তববাদী নীতি: দল কোনো নির্দিষ্ট "মহান আদর্শ" (Grand Ideology) চাপিয়ে না দিয়ে, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট ও সমস্যা অনুযায়ী বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। 
স্থানীয় সমস্যা ও সমাধান: জাতীয় ইস্যুর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও সমস্যার ভিত্তিতে দলীয় এজেন্ডা নির্ধারণ করা হবে।
৪. গ্লোবালাইজেশন ও লোকালাইজেশনের সমন্বয় (Glocal Politics)
আন্তর্জাতিক সংযোগ: গ্লোবাল প্র্যাকটিস ও উদ্ভাবনী ধারণা গ্রহণ করা হবে, তবে তা স্থানীয় বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে প্রয়োগ করা হবে।
স্থানীয় স্বনির্ভরতা: কৃষি, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদন ও উদ্যোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
৫. তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও স্বচ্ছ দলীয় কাঠামো
ডিজিটাল অংশগ্রহণ: দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অ্যাপ ও ব্লকচেইনভিত্তিক ভোটিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
স্বচ্ছ অর্থায়ন: দলীয় তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের বিষয়ে অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম থাকতে হবে, যাতে জনগণ জানে দল কীভাবে অর্থ ব্যয় করছে।
৬. সংস্কৃতি ও আবেগনির্ভর রাজনীতির স্বীকৃতি
রাজনীতির ভাষা ও প্রচারণা: জনগণের আবেগ, সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রচারণা ও নীতিগত বার্তা তৈরি করা হবে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি: বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও জাতিসত্তার উৎসব, ভাষা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। উত্তর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল হতে হবে তৃণমূলভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, বিকেন্দ্রীভূত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এটি কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শকে একমাত্র সত্য বলে মানবে না, বরং বাস্তবতাভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ রাজনীতির মডেল গড়ে তুলবে।

কালেক্টিভ লিডারশিপ (Collective Leadership):
কালেক্টিভ লিডারশিপ হলো এমন একটি নেতৃত্ব ব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার একক নেতার ওপর না থেকে একটি দল বা কমিটির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এটি ঐতিহ্যবাহী ঊর্ধ্বমুখী (top-down) নেতৃত্বের পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক ও সমষ্টিগত নেতৃত্বের উপর গুরুত্ব দেয়।
কালেক্টিভ লিডারশিপের মূল বৈশিষ্ট্য
✅ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকেন্দ্রীকরণ: সিদ্ধান্ত একক ব্যক্তি না নিয়ে, একটি সমষ্টিগত দল বা বোর্ড নেয়। 
✅ সহযোগিতামূলক নেতৃত্ব: বিভিন্ন ব্যক্তি বা দলের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নেতৃত্ব ভাগ করা হয়। 
✅ নতুন নেতা তৈরির সুযোগ: এটি ভবিষ্যৎ নেতাদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি করে। 
✅ সচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা: যখন সিদ্ধান্ত একাধিক ব্যক্তি নেয়, তখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়। 
✅ বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি: বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ নেতৃত্বে আসতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কালেক্টিভ লিডারশিপের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো এখনো মূলত এককেন্দ্রিক বা ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটি সমতাভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কালেক্টিভ লিডারশিপ জরুরি।
✔ দলীয় প্রধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে – বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রধান ব্যক্তির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। এটি কমিয়ে সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। দলীয় একনায়কতন্ত্র কিংবা যেকোন ইস্যুতে দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ, গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা করতে হবে না। এতে খয়েরখাঁদের আবির্ভাবের সুযোগ থাকবে না। 
✔ ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ বাড়াবে – একটি স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি হবে। 
✔ দলীয় বিভক্তি কমাবে – একক ব্যক্তির আধিপত্যের কারণে দলের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়, তা কমবে। 
✔ স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষমতায়ন – শুধু কেন্দ্র নয়, প্রতিটি স্তরের নেতা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।

কালেক্টিভ লিডারশিপের সম্ভাব্য কাঠামো
১. সমষ্টিগত নির্বাহী বোর্ড (Collective Executive Board)
৫-৭ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড থাকবে, যেখানে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব ভাগ করা হবে। প্রতিটি সদস্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুখপাত্র বা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গণভোট বা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
২. বিকেন্দ্রীভূত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত তৃণমূলের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হবে। ডিজিটাল ভোটিং, কর্মশালা এবং উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ করা হবে।
৩. স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ক্ষমতায়ন
প্রতিটি জেলা বা উপজেলা কমিটি নিজেদের স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পাবে। কেন্দ্রীয় দল কেবলমাত্র দিকনির্দেশনা দেবে, কিন্তু স্থানীয় সমস্যার সমাধান স্থানীয় কমিটিই করবে।
কালেক্টিভ লিডারশিপ একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ব্যবস্থা যা এককেন্দ্রিক নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে রাজনীতিতে এটি প্রয়োগ করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে আরো বেশি কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।


সংক্ষিপ্ত ইশতেহার 
ভূমিকা
....পার্টি একটি বিকল্পধারার রাজনৈতিক দল যা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা এবং বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে। আমরা আদর্শিক কঠোরতার পরিবর্তে বাস্তবসম্মত সমাধানের পক্ষে। আমাদের লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠন।... পার্টি একটি সার্বভৌম, স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা ইসলামী মূল্যবোধ, জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দেশকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর জন্য কাজ করবো।

১. বিকেন্দ্রীভূত ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র
কেন্দ্রীভূত রাজনীতির পরিবর্তে তৃণমূল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি।
প্রতিটি জেলা ও উপজেলার জন্য আলাদা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ব্লকচেইন ও ডিজিটাল ভোটিংয়ের মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
সমাজে নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার।

২. পরিচয়ের বহুমুখিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি
নারীদের জন্য ৫০% রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা ও সমান সুযোগ প্রদান।
তরুণদের নেতৃত্বে আনতে ৩৫ বছরের নিচের নাগরিকদের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা বা প্রণোদনা।

৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
সরকারি ও দলীয় তহবিল ব্যবস্থাপনা অনলাইন ট্রান্সপারেন্সি পোর্টালের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
রাজনৈতিক নেতাদের সম্পদ ঘোষণাকে বাধ্যতামূলক করা।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ।

৪. প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন ও ডিজিটাল অর্থনীতি
সকল সরকারি সেবাকে শতভাগ ডিজিটালাইজড করা।
স্থানীয় স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তাদের জন্য বিনামূল্যে ট্রেনিং ও বিনিয়োগ সহায়তা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি।
ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার
সুদমুক্ত অর্থনীতির ভিত্তিতে একটি ন্যায়সঙ্গত ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
যাকাত, সদকা ও দান ব্যবস্থার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ ও ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ প্রদান।
হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে।
সকল ধরণের ব্যবসায়িক অসততার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ। 

৫. টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব নীতি
২০৪০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫০% কমানোর প্রতিশ্রুতি।
গ্রিন এনার্জি ও নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে সরকারিভাবে বিনিয়োগ। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
প্লাস্টিক ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ।
প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং অপচয় রোধ করা।
পরিবেশ সংরক্ষণে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ভূমিকা বাড়ানো।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।

৬. শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
সকল স্তরের শিক্ষাকে বিনামূল্যে ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা। নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ করা।
বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও বীমা সুবিধা প্রদান। মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনধারাকে জাতীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা।
যুব সমাজকে নৈতিক ও নেতৃত্বমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা।

৭. স্থানীয় ও বৈশ্বিক সংযোগ (Glocal Politics)
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্থানীয় উৎপাদন ও কৃষিকে আধুনিকায়ন করা।
বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রোধ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তথ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

৮. ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা।
ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মুসলিম বিশ্বসহ সকল বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্মানজনক ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রাখা।
রোহিঙ্গা সংকটসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা পালন।
ব্লু ইকোনমি, ট্রান্সপোর্ট করিডোর, বন্দর ও আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারে কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিতে আত্মনির্ভরতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
মুসলিম দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়ন।
বৈশ্বিক শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশি প্রভুত্ব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখার নীতি গ্রহণ করা হবে।
প্রতিবেশী দেশের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক বজায় রাখা হবে।

৯. ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা
উত্তর আধুনিকতা ও উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তার অবস্থান থেকে ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদার অবস্থান গ্রহণ। 
পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নৈতিকতার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযান।
ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে সকল সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণ করা।
মুসলিম রেনেসাঁ তৈরিতে শতবর্ষ মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ। 

১০. প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করা হবে।
সাইবার নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে কঠোরভাবে।

১১. কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন
কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি সরবরাহ করা হবে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিনীতি গ্রহণ করা হবে।
গ্রামীণ অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে।

১২. আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হবে।
পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইন্টারনেট ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ সাইবার নিরাপত্তা আইন কার্যকর করা হবে।

১৩. বিচারব্যবস্থা ও ন্যায়বিচার
বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা হবে, যাতে সকল নাগরিক সমানভাবে ন্যায়বিচার পায়।
দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ আদালত ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে।
শরিয়াহ আইনের আলোকে পারিবারিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বিকল্প বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ব্লাসফেমি ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হবে।

১৪. আইন ও সংসদীয় ব্যবস্থা
আমরা বিশ্বাস করি, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য আইনের শাসন ও কার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমাদের পরিকল্পনা নিম্নরূপ—
১. সংবিধান ও আইনের সংস্কার
সংবিধানকে ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে।
সংবিধানের এমন ধারা যেগুলো জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, সেগুলো পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে।
ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা হবে।
কুর'আন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না। 
২. সংসদীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র
সংসদকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আইন প্রণয়নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হবে।
সংসদ সদস্যদের জন্য যোগ্যতা ও নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হবে, যাতে সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
বিরোধী দলের যথাযথ ভূমিকা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভারসাম্য আনয়ন। 
সংসদ এক কক্ষ বিশিষ্ট হবে। তবে সংসদীয় আসনের যৌক্তিক পুনর্বিন্যাস করে আসন সংখ্যার বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হবে। 

উপসংহার
আমাদের লক্ষ্য, একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর আইন ও সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে বাংলাদেশ একটি আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।...পার্টি বিশ্বাস করে যে সত্যিকারের কল্যাণমুখী রাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, বরং সমাজে ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও সামগ্রিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য হওয়া উচিত। আমরা চাই একটি ন্যায়ভিত্তিক, নৈতিক ও অধিকারভিত্তিক বাংলাদেশ। .... পার্টি আরও বিশ্বাস করে, গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং নীতিনির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ ও মানবিক বাংলাদেশ।

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.