চিকিৎসকের ভিজিট ফি, সময় এবং অন্যান্য || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||

 


চিকিৎসকের ভিজিট ফি, সময় এবং অন্যান্য

বাপ্পা আজিজুল


'চিকিৎসকেরা রোগীদের সময় দেন না' এটি একটি কমন অভিযোগ। কতটুকু সময় দেয়া উচিত? এ নিয়ে কোন গ্রহণযোগ্য নির্দেশনা নেই। মাঝেমধ্যে সরকার সময় ও ব্যক্তিগত চেম্বারের ভিজিট ফি নির্ধারণের চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো কারণে সেগুলো কয়েকদিন আলোচনা/সমালোচনা হওয়ার পরে আর আলোর মুখ দেখে না। এই নীতি নির্ধারণে যারা অংশ নেন, তারা চিকিৎসকদের প্রেক্ষিত বুঝেন না বা আমলে নেন না, এমন আক্ষেপ চিকিৎসকদের। এখানে বরাবর একটা শ্রেণীকরণ কাজ করে। চিকিৎসকদের বাই ডিফল্ট শোষণকারী, বুর্জোয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। একে চিকিৎসকেরা Frustration leads to aggression হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ আমলা-মন্ত্রীরা নিজেরা চিকিৎসক হতে না পেরে এমন ঝাল মিটানোর চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। দূর্নীতিও কম নয়। স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভঙ্গুর। রিসোর্সকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। রেফারেল সিস্টেম প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর হয়নি। নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে প্রাথমিক জ্ঞান উৎপাদন ও এভিডেন্সভিত্তিক অনুশীলনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনভিত্তিক নিজস্ব পলিসি, আইন, গাইডলাইন নেই। 


ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা (সরকারি হাসপাতাল,  প্রাইমারি কেয়ার লেভেল অর্থাৎ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত) রোগী দেখতে গড়ে মোটে ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন। জার্নালটি আরও জানাচ্ছে, ভারতে চিকিৎসকেরা রোগীকে প্রায় আড়াই মিনিট দেন (Irving et al., 2017)। সেটিও খুব কম। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত সময়ের তুলনায় অনেক কম, কারণ দেশে ডাক্তার-জনসংখ্যার অনুপাত অত্যন্ত কম এবং অতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকে। এই অল্প সময়েই ডাক্তারদের রোগীর সম্পূর্ণ সমস্যার সমাধান দিতে হয়, যা অনেক সময় সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে প্রতি ১,০০০ জনে মাত্র ০.৮৩ জন ডাক্তার আছেন, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এই কম সংখ্যার কারণে ডাক্তারদের উপর রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকে। ডাক্তারদের কম সময় দেওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো তাদের উপর রোগীর অতিরিক্ত চাপ। একসঙ্গে অনেক রোগীর চিকিৎসা করতে হয় বলে তারা প্রত্যেককে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই যেখানে একজন ডাক্তার ঠিক কতটুকু সময় রোগীর পেছনে দেবেন অথবা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতজন রোগী দেখবেন, তা ঠিক করা থাকে। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হয়। ডাক্তাররা সময় না দেওয়ায় রোগীরা তাদের সমস্যাগুলো সম্পূর্ণভাবে বোঝাতে পারেন না এবং মানসিক স্বস্তি পান না, যা তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। সময় কম দেওয়ায় ডাক্তারদের প্রতি রোগীদের আস্থা কমে যায়, কারণ তারা মনে করেন ডাক্তাররা তাদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরাও এই ধরণের কারণ উল্লেখ করে থাকেন। এদিকে আরেকটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গড়ে ১০ মিনিট করে রোগীকে সময় দেয়া হয় (২৫.৮% রোগী), আবার আরও ২৫% রোগী যারা ১০ মিনিটের বেশি সময় পান। এবং অধিকাংশ চিকিৎসক (৯২%) মনে করেন, রোগীর জন্য ১০ মিনিট সময় পর্যাপ্ত নয় (Das et al., 2021)। এই গবেষণাটি বাংলাদেশী মিডিয়ার চোখে না পড়লেও ব্রিটিশ জার্নালের দেয়া পরিসংখ্যানটি তারা বেশ ফলাও করে প্রচার করেছেন। মজার ব্যাপার, তারা আর্টিকেলটির ভেতরে নূন্যতম চোখ বুলাননি। এবস্ট্র‍্যাক্ট কিংবা রেজাল্ট দেখে ৪৮ সেকেন্ড সময়টি চাউর করেছেন। অথচ টেবিল-১ দেখাচ্ছে, বাংলাদেশে এব্যাপারে তারা ৪ বার তথ্য সংগ্রহ করেছেন, এর মধ্যে ১৯৯৪ সালের একটি হিসাবে ৪৮ সেকেন্ড পেলেও ২০১২ সালের লেটেস্ট হিসাব অনুযায়ী রোগী প্রতি গড় সময় ছিল ৩.৮ মিনিট।


প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিসে রোগীপ্রতি গড় সময় দানের কোনো গবেষণা আমাদের নজরে আসেনি। তবে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিকের রিপোর্ট অনুযায়ী (৭.৭.২৪), 

চেম্বারে হাজার টাকায় গড়ে তিন মিনিটের সেবা পাওয়া যায় (কালেরকন্ঠ, ২০২৪)। যদিও পত্রিকাটিতে কয়েকজন রোগীর সাক্ষাতকারকে ভিত্তি করে যে পরিসংখ্যান টানা হয়েছে তা যথেষ্ট ও তাত্ত্বিকভাবে নির্ভুল নয়। ঝোঁকপ্রবণতা, পূর্বানুমান ও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। 


একজন স্পেশালিষ্ট চিকিৎসক কতক্ষণ রোগীকে সময় দেবেন সেটির কোন ধরাবাঁধা নিয়ম বা সীমা নেই। তবে জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ৩০ ভাগ চিকিৎসক তাদের রোগীদের গড়ে ১৭-২৪ মিনিট সময় দেন, যা একটি আদর্শ ভিজিট হিসেবে পরিগণিত হয় (Wood, 2023)। আমেরিকাতে একজন জিপি চিকিৎসকের ভিজিট ফি ৮০-১৭০ ডলার (Fay, 2018)। আরেকটি গবেষণা অনুযায়ী ইউএসএ হল চিকিৎসক ভিজিট খরচের দিক থেকে বিশ্বে ৮ম জাতি (১০৪ ডলার)। ১৫ মিনিটের একটি ভিজিটে ফি'র জন্য সর্বাগ্রে আছে ডেনমার্ক (২৪০ ডলার), সবচেয়ে কম খরচ ভেনিজুয়েলা (৩.৪১ ডলার), আমাদের বাংলাদেশে ১২ ডলার (Weiss, 2022)। 


সরকারি সেটিংসে রোগীকে ফেরত দেয়া বা 'না' বলা সম্ভব নয়। তাই জনসংখ্যার চাপ, নিম্ন আয়, রেফারেল সিস্টেমের অকার্যকারিতা, স্টিগমা, স্বাস্থ্য বিষয়ক অসচেতনতা (health illiteracy) ইত্যাদি কারণে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসক কম থাকায় রোগীর জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রাইভেট চেম্বারে একজন চিকিৎসক চাইলে রোগী সংখ্যা লিমিট করে দিয়ে সময় নিয়ে অল্প রোগীকে অধিক মনোযোগ ও যত্ন নিয়ে দেখতে পারেন। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পরিসীমা অনুযায়ী ভিজিট ফিও রাখতে পারেন। আশা করা যায় এতে রোগীর তুষ্টি বাড়বে, চিকিৎসকের সময় বাঁচবে, শ্রম কমবে, স্ট্রেস কমবে এবং রিটার্নও মন্দ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকরাও দেহ-মন-আত্মার সমন্বয়ে একজন মানুষ। তাদের শারীরিক, মানসিক চাপ ও পরিশ্রমের কারণে বার্ন আউট হতে পারে। খোদ আমেরিকাতেই ৫৪.৪% চিকিৎসক বার্ন আউটের শিকার এবং তারা তাদের কাজ-জীবনের ভারসাম্যহীনতায় অসন্তুষ্ট (Shanafelt et al., 2015)। 


Who will watch the watchman? সুতরাং ডাক্তারদের নিজেদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। নিজেকে একান্ত সময় দিতে হবে। পরিবারকে সময় দিতে হবে। রোগীকেও সময় দিতে হবে। সনাতন ধর্মের শিক্ষকদের কাছে আমরা শুনেছি, রোগী হল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে ফেরত দিতে নেই। অসম্মান করতে নেই। অবহেলা করতে নেই। আবার মুহাম্মদ সা. এর হাদিস থেকে জানা যায়- রোগী দেখা ইবাদত। এতে প্রচুর সওয়াব পাওয়া যায়। তাহলে ইবাদতে দরকার ইখলাস বা একাগ্রতা/একনিষ্ঠতা। ইবাদতে তাড়াহুড়ো চলে না। সময় ও মনোযোগ দিয়ে ইবাদতে ফায়দা বেশি। এবিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি 'চিকিৎসা পেশায় আধ্যাত্মিকতা ও উৎকর্ষ' শিরোনামে (https://www.manoslok.com/2024/12/blog-post.html)। এছাড়া ইংরেজি Hospital শব্দটি এসেছে ল্যাতিন 'হসপিতেল' শব্দ থেকে যার অর্থ মেহমানখানা/অতিথিশালা। তাই রোগীকে অতিথি জ্ঞান করা হয়। অতিথি আসার যেমন কোন তিথি বা ক্ষণ নাই, তেমনি রোগীও-যেকোন সময় এসে দুয়ারে কড়া নাড়তে পারে। অতিথিকে যেমন আপনি স্বাগত জানাবেন হাসিমুখে, আপ্যায়ন করবেন সাধ্যমত, এরপর বিদায়ও নিশ্চয় সহাস্য বদনেই দেবেন, রোগীও অনুরূপ ব্যবহার পাওয়ার হকদার। ব্যক্তিগত চেম্বারে একজন চিকিৎসকের করণীয়গুলো সংক্ষেপে তালিকাবদ্ধ করলে এরকম হতে পারে-


১. প্রত্যেক রোগীকে কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় দেব। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে একটি আদর্শ ভিজিটের সময় ১৭-২৪ মিনিট। 

২. চেম্বারে একদিনে ১০/২০ জনের বেশি রোগী দেখব না। বিশেষ অনুরোধ বা জরুরি হলে ভিন্নকথা। 

৩. রিপোর্ট দেখানো বা রোগীর অনুপস্থিতিতে জরুরি পরামর্শ বা বুঝের জন্য ভিজিট লাগবে না। 

৪. সাদা কোট পড়ে (ড্রেস কোড মেনে) চেম্বার করব। 

৫. রোগী দেখা ইবাদত। ইবাদতে লাগে ইখলাস, মনোযোগ ও স্থিরতা। তাই রোগী দেখার সময় ফোন সাইলেন্ট থাকবে। কোন ফোনকলে এটেন্ড করব না। কাউকে বসিয়ে গল্প করা বা মনোযোগের ব্যত্যয় হয় এমন কিছু করব না। 

৬. রোগী হল অতিথি। তাঁকে যথোপযুক্ত সম্মান দেব। সালাম দেব। হাসিমুখে কথা বলব। সাধ্যমত আপ্যায়নের চেষ্টা করব। 

৭. অসচ্ছল রোগীদের ব্যাপারে সর্বদা ছাড় দেয়ার চেষ্টা করব। 

৮. প্র‍্যাক্টিসে সর্বদা মেডিকেল ইথিক্স ও ইসলামি (ধর্মীয়) নৈতিকতা মেনে চলব। 

৯. সপ্তাহে ৫ দিনের বেশি প্র‍্যাক্টিস নয়। 

১০. প্রত্যেক রোগীকে মানসম্মত ব্যবস্থাপত্র, রোগ সম্পর্কে সচেতনতার জন্য উপযুক্ত কাউন্সেলিং ও প্রিন্টেড ম্যাটেরিয়ালস যোগান দেব।


বিখ্যাত কবি কাহলিল জিবরানের এই বাক্যগুলো চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্য তৃপ্তিদায়ক হতে পারে- 

"তোমাদের বেশিরভাগ ব্যথা তোমাদের নিজের পছন্দের। তোমাদের হৃদয়ের চিকিৎসক সেই, যে ওষুধ দিয়ে অসুস্থ মনকে সুস্থ করেন আর তা হল তিক্ত বেদনা। অতএব, চিকিৎসকের উপর আস্থা রাখো এবং নীরবে ও শান্ত হৃদয়ে তাঁর প্রতিষেধক পান করো। কারণ চিকিৎসকের হাত গুরুভার এবং কঠোর হলেও, এটি অদৃশ্যের হাত দ্বারা পরিচালিত হয়। এবং যদিও তাঁর হাতে ধরা পেয়ালা থেকে তোমার ঠোঁট জ্বলে ওঠে, তবুও পেয়ালাটি স্রষ্টার পবিত্র অশ্রুতে ভেজা মাটি দিয়ে তৈরি"।


রেফারেন্স:

Das, M. C., Zakaria, M., Cheng, F., & Xu, J. (2021). Appointment Length with Patients in Medical Consultations in Bangladesh: A Hospital-Based Cross-Sectional Study. Healthcare (Basel, Switzerland), 9(9), 1164. 

Fay, B. (2018). How Much A Doctor Visit Will Costs You - Blue Book Prices. Debt.org. 

Irving, G., Neves, A. L., Dambha-Miller, H., Oishi, A., Tagashira, H., Verho, A., & Holden, J. (2017). International variations in primary care physician consultation time: a systematic review of 67 countries. BMJ Open, 7(10).

(2024). Kalerkantho.com. https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/07/07/1404124

Shanafelt, T. D., Hasan, O., D., Sloan, J., & West, C. P. (2015). Changes in Burnout and Satisfaction With Work-Life Balance in Physicians and the General US Working Population Between 2011 and 2014. Mayo Clinic Proceedings, 90(12), 1600–1613. 

Weiss, S. (2022). The Global Cost of a Trip to the Doctor and Common Hospital Regrets. Weiss & Paarz. 

Wood, D. (2023). Average Time Doctors Spend With Patients | Staff Care. Amnhealthcare.com. 

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.