মনোরোগ: নববি চিকিৎসা || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||

 


মনোরোগঃ নববি চিকিৎসা

বাপ্পা আজিজুল

১.১. মন: 

মন সম্পর্কে ৩ ধরণের মতামত পাওয়া যায়। বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদের মতে, মন বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই। মানুষের মস্তিষ্কের (brain) বিভিন্ন অঞ্চল(area), স্নায়ুসন্ধি (synapse), পাথওয়ে, সার্কিট ও নিউরোট্রান্সমিটারের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কারণ ব্রেইনের এই নির্দিষ্ট অংশগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন কিংবা ক্ষতিসাধনের কারণে মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, প্রত্যক্ষণ, আচরণ, স্মৃতি, অন্তর্দৃষ্টি প্রভৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। মনোবিদ ও আচরণবিদেরা তত্ত্বটিকে সমর্থন করে। 

দ্বিতীয় মত অনুসারে, মনের পৃথক অস্তিত্ব আছে যা মানুষের ব্রেইন, পক্ষান্তরে চিন্তা, আচরণ ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মতের পক্ষে স্নায়ুবিদেরা। উল্লেখ্য একজন হলেন  নোবেলজয়ী স্নায়ুবিজ্ঞানী John Eccles। তাদের যুক্তি- এই অপার্থিব সত্তা আমাদের বুদ্ধিমত্তার ব্রডকাস্টিং স্টেশন, আর ব্রেইন কেবল একটি টেলিভিশন সেট। এর স্বপক্ষে তারা বলেন- আমরা অনেক সময় ব্রেইনের নির্দেশের বিপরীতে কাজ করি। এটা কিভাবে সম্ভব হয়? আবার যখন ব্রেইন ডেথ হয় তখনও মানুষের মনকে সীমিত মাত্রায় সক্রিয় দেখা যায়। 

৩য় মতটির পক্ষেও একদল চিকিৎসক বিজ্ঞানীরা রয়েছেন, যারা বলছেন- মানুষের হার্ট বা হৃদযন্ত্র কেবল একটি পাম্পযন্ত্র নয় (রক্ত পাম্প করে সংবাহিত করা), আরও অনেক কিছু। এর নিজস্ব একটি স্নায়ুতন্ত্র আছে যাকে হার্টের ব্রেইন বলা যায়। এখান থেকে সিগন্যালিং এর মাধ্যমে ব্রেইনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই হার্টকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে সুপার পাওয়ার এনার্জি (ইসলামি পরিভাষায় যাকে রুহ বলা হয়)। বিজ্ঞানী Joseph Pearce এবিষয় নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন ক্রিশ্চিয়ান বার্নাডকে উদ্ধৃত করেন। বার্নাড বলেন-  "একারণে আমাদের কৃত্রিম হার্ট প্রতিস্থাপনের চিন্তা ত্যাগ করতে হবে"। এর স্বপক্ষে Pearce দেখান, হার্ট প্রতিস্থাপনের পরে গ্রহীতার ব্যক্তিত্বে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে যা দাতার (donor) ব্যক্তিত্বের সদৃশ (মালিক বাদরি,  ২০০০)।

৩য় মতটি ইসলামি পরিভাষায় বর্ণিত কলবের সাথে মিলে যায়, যাকে ইমাম গাজালি স্পিরিচুয়াল হার্ট বলেছেন। সাইকোথেরাপিস্টরা মনকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন-

১. আবেগীয় মন (Emotional mind)

২. যৌক্তিক মন (Rational mind)

৩. বিজ্ঞ মন (Wise mind)



অধিকাংশ মানুষের মন প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। অতি আবেগ কিংবা অতি যুক্তির মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই নিয়ন্ত্রিত আবেগ ও যুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞচিত চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেয়া ও আচরণ করতে পারে। 

ফ্রয়েডের তত্ত্বানুসারে মনের ৩টি রূপ। অদ (Id), অহম (Ego), অতি অহম (Super ego)। অদ মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি। কামনা-লালসা চরিতার্থ করাই তার একমাত্র কাম্য। সেজন্য সে কোন কিছুর বাছ-বিচার বা ধার ধারে না। অহম অদের ঊপরে বাস্তবতা ও যুক্তির একটি প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। মানুষ তখন সমাজ বা আইনী স্বীকৃত উপায়ে তার কামনা-বাসনা হাসিল করতে চায়। অতি অহম এতে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ যুক্ত করলে মানুষ তখন মানবিক হয়ে ওঠে। 



সাইকোথেরাপিস্ট লিনহ্যামের দেয়া মনের শ্রেনীভাগ কিংবা ফ্রয়েডের মনের উন্নয়ন তত্ত্বের আলোকে বর্ণিত ৩টি স্তরের সাথে কুর'আনে বর্ণিত নফসের ৩টি অবস্থার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। বলা যায়, তাদের পর্যবেক্ষণজনিত জ্ঞান অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি। কেউ যখন কোন কল্যাণকর কিছুর জন্য অত্যাধিক ফিকির করে, আল্লাহ তখন ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে সমাধান দান করেন, সত্যের পথে অগ্রসর করেন। সেক্ষেত্রে মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। দার্শনিকদের একটা দাবি হল, "মানুষের বিবেক আল্লাহ এবং সকল বাস্তবতা সম্পর্কে জানা ও বুঝার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন, যেমন এটি ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে সক্ষম। ওহি দরকার আমজনতার জন্য যাদের বিবেক, আবেগ দ্বারা অবদমিত। তাদের জন্যই যুগে যুগে নবি পাঠানো হয়েছে, তাদের ভাষাতেই পাঠানো হয়েছে যেন তারা এর দৃষ্টান্ত ও রূপক কথাগুলো বুঝতে পারে। যখন পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হবে এবং অলংকারহীন ভাষায় উপস্থাপিত হলে, তাদের তত্ত্বগুলো দার্শনিকদের চিন্তাধারা থেকে খুব বেশি আলাদা হবে না যা তারা বিবেকের যুক্তি দিয়ে আবিষ্কার করেছে। সত্য সব একই রকম, তা প্লেটো-এরিস্টোটল বলুক আর মুসা-মুহাম্মদই বলুক। সত্য জানার অসাধারণ ক্ষমতা ছাড়াও একজন নবিকে অসম্ভব শক্তিশালী কল্পনাশক্তি দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে যার দরুন তিনি ন্যায়ানুগ যুক্তিসমূহকে ভৌতজ্ঞানের আকারে উপস্থাপন করতে পারেন এবং অলৌকিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারেন। যা হোক, এই ক্ষমতাগুলো নবি ছাড়াও অনেকের মধ্যে বিভিন্ন অনুপাতে বিরাজমান থাকে" (আনসারি, ২০০৫)। 

দার্শনিকদের এই দাবি পুরোপুরি নয়, আংশিক সত্য। মানবজাতির জন্য নবির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। নবি-রাসুলেরা হলেন তাদের সম্প্রদায়ের সর্বোত্তম মানুষ। শক্তিশালী মন ও মননের অধিকারী। সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ এবং স্বীয় সমাজে সম্মানিত। কিন্তু নবুয়তকে প্রাকৃতিক উপহার ভাবা যাবে না, এমনকি সমাজের সবচেয়ে প্রতিভাধর কেউ নবি হবেন সেটিও নয়। নবুয়ত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুগ্রহ, তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য যাকে ইচ্ছা সেটির জন্য মনোনীত করেন। তিনি তাঁকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দান করেন কার্যসিদ্ধির জন্য এবং তাঁকে অতিপ্রাকৃতিক উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। সর্বপ্রথম আল-ফারাবি, পরবর্তী সময়ে ইবনে সিনা, তারপর অন্যান্য দার্শনিকেরা, এমনকি কিছু সুফিও, নবুয়তকে একটি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ মনে করে। তারা বলেছেন, একজন নবি তাঁর সমাজের অন্যদের চেয়ে এজন্য আলাদা যে, তাঁর জানার অসাধারণ ক্ষমতা আছে, বিস্ময়কর ও শক্তিশালী কল্পনাশক্তি আছে যার কারণে তাঁর ভাবনাগুলো জাগ্রত অবস্থায় বা স্বপ্নে তাঁর কাছে দৃশ্যমান হয়। এবং তাদের অলৌকিকতা নিয়ে কাজ করার মতো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মানস রয়েছে। 

ইবনে তাইমিয়া বিশদভাবে নবুয়ত সম্পর্কিত এই তত পর্যালোচনা করেন। তিনি নোকতা দেন যে, প্রথমত, নবুয়ত কোন প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ নয়। এমন কিছু নয় যা নবিরা নিজে অর্জন করেন। এটি স্রেফ আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। দ্বিতীয়ত, তাঁর উপর নাযিলকৃত ওহি কোন তত্ত্ব বা ধারণা নয় যা তিনি নিজে আবিষ্কার করেছেন। বরং সেগুলো আল্লাহ প্রদত্ত। তৃতীয়ত, তাঁর কাছে ফেরেশতা আসতেন বা গায়েবের যে বিষয়গুলো তাঁর কাছে দৃশ্যমান হত, সেগুলো তাঁর মনোজগতের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয় নয়, বরং বহির্জগতের। এগুলো আদৌ তাঁর অন্তরের সৃষ্টি বা কল্পনাপ্রসূত নয়। এবং যে মুজিযা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন, সেগুলো তাঁর মনের শক্তির জোরে নয়, সেগুলো আল্লাহ তায়ালা নিজের ক্ষমতায় সম্পন্ন করিয়েছেন। উপরন্তু এই মুজিযাগুলো ভবিষ্যদ্বক্তা, দৈবজ্ঞ বা যাদুকরের ভেল্কিবাজির মতো অবাস্তব ও প্রকৃতির সাধারণ বিধানের ব্যত্যয় নয়, বরং বাস্তবতা ও প্রাকৃতিক বিধানের সাথে সংগতিশীল।

একজন প্রকৃত নবি ও মিথ্যা দাবিদারের মধ্যে পার্থক্য করার অন্যতম একটি উপায় হল তাদের মুজিযা পর্যবেক্ষন করা। নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার কেউ যখন ভবিষ্যদ্বাণী করবে, সেটির মধ্যে অবশ্যই ভুল ও মিথ্যা মিশ্রিত থাকবে। প্রাকৃতিক কোন লক্ষ্যবস্তুর উপর তার ভেল্কিবাজি হবে অগভীর এবং প্রকৃতির নিয়মের সাথে কদাচিৎ সংগতিশীল। সে অস্বাভাবিক যা কিছু অবলোকন, অনুধাবন করে তা শয়তানের প্রবঞ্চনা। তারা নিজেদের জীবনে, এমনকি তাদের অনুসারীদের জীবনেও কোন ভালো প্রতিফল তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে, একজন সত্যনবির সর্বোত্তম প্রমাণ হলো তাঁর জীবন, তাঁর দেয়া শিক্ষা, তাঁর কর্ম এবং অনুসারীদের জীবনে সেসবের ইতিবাচক প্রভাব। 


১.২: মনোরোগ

মনোরোগকে মোটাদাগে দুই ভাগে ফেলা যায়- 

১।  মেজর বা বড়; সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজর্ডার, মেজর ডিপ্রেশন ইত্যাদি। এসব রোগে সাইকোসিস অর্থাৎ ভ্রান্ত বিশ্বাস (delusion) ও অলীক প্রত্যক্ষণ (hallucination) থাকে, তাই এদেরকে সাইকোটিক (psychotic) রোগও বলা যায়। 

২।  মাইনর বা ছোট; দুশ্চিন্তাজনিত রোগ, শুচিবায়ু, যৌন সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, মাদক বা আত্মহত্যার ধারণা, ব্যক্তিত্বের বিকৃতি, কনভার্সন ডিজঅর্ডার ইত্যাদি। এদেরকে নিউরোটিক (neurotic) রোগ বলে।


১.৩ চিকিৎসা:

১. রোগ আসলে ভয় পাবেন না, হতাশ বা অস্থির হবেন না। এই রোগ আপনার গোনাহের কাফফারা বা মোচনকারী হতে পারে। নবি সা. বলেছেন: মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন (বুখারি, ৫৬৪১-২)।


২. আপনার অসুখ, কষ্টকে মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জীবনযুদ্ধে হেরে গেলে চলবে না। "মু’মিন ব্যক্তির দৃষ্টান্ত হল, শস্যক্ষেতের নরম চারাগাছের মত। যে কোন দিক থেকেই তার দিকে বাতাস আসলে বাতাস তাকে নুইয়ে দেয়। আবার যখন বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হয় তখন তা সোজা হয়ে দাঁড়ায়" (বুখারি, ৫৬৪৪)।


৩. ধাতু আগুনে পুড়ে খাটি হয়। মানুষও তেমন। দুঃখ-কষ্ট, মানসিক চাপ আপনাকে অভিজ্ঞ করবে। পরিণত করবে। এর সুফল আপনি পরবর্তীকালে অবশ্যই ভোগ করবেন। আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ কামনা করেন তাকে তিনি দুঃখকষ্টে পতিত করেন (বুখারি, ৫৬৪৫)। দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলে মুক্তির জন্য দু'আ করা যেতে পারে। এটা এক ধরণের অটোসাজেশন ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে। ‘আমি দুঃখ কষ্টে নিপতিত হয়েছি, তুমি তো দয়ালুদের সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সূরা আল-আম্বিয়া ২১: ৮৩)


৪. অসুস্থ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় তরল খাবার রোগের উপশম করে, মানসিক অবসাদে প্রশান্তি আনে, দুশ্চিন্তা দূর করে। একটু হালকা গরম দুধ বা স্যুপ বা ফলের রস জাতীয় তরল খাবার পথ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। 


আয়িশা রা. হতে বর্ণিত যে, তিনি রোগীকে এবং কারো মৃত্যুজনিত শোকাহত ব্যক্তিকে তরল জাতীয় খাদ্য খাওয়ানোর আদেশ করতেন। তিনি বলতেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি যে, ‘তালবিনা’ (Milk like soup) রোগীর কলিজা মযবুত করে এবং নানাবিধ দুশ্চিন্তা দূর করে। (সহিহ বুখারি ৫৬৮৯)


৫. রাগ বা ক্রোধ খুব ভয়ানক ও ক্ষতিকর আবেগ। রাগ এলে সংবরণ করা জরুরি। অনেকেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। রোগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রকৃত বীরত্বের কাজ। যেমন নবি সা. বলেছেন, "সে বীর বিক্রম নয়; বরং (প্রকৃত বীর সে-ই) যে রাগের মুহুর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে" (মুসলিম, ৬৫৩৫)। ছোট্ট একটি অভ্যাস রাগ দমনে সহায়ক হতে পারে। 

নবী সা. বললেন, আমি এমন একটি দু’আ জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে আ‘ঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম।’’-আমি শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। তবে তার রাগ চলে যাবে। তখন তাকে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তুমি আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় চাও। (সহিহ বুখারি ৩২৮২)

রাগ নিয়ন্ত্রণের আরেকটি অব্যর্থ ও কার্যকরী কৌশল হল রাগের উৎস থেকে সরে আসা কিংবা ফোকাস বা মনোযোগ সরিয়ে নেয়া, অন্যদিকে বা কাজে মনোনিবেশ করা। আবু যার রা. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমাদের কারো যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয় তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথায় সে যেন শুয়ে পড়ে (আবু দাঊদ ৪৭৮২)। এছাড়া রাগ প্রশমনে অযু করার পরামর্শও পাওয়া যায়- "অতএব তোমাদের কারো রাগ হলে সে যেন উযু করে নেয়"। (আবু দাঊদ ৪৭৮৪)


৬. হতাশা মাঝেমধ্যে আমাদের গ্রাস করে। আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। হা-হুতাশ করি। দানাপানি বন্ধ করি। কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলি। জীবন অর্থহীন মনে হয়। আরও মনে হয় বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। এক জীবনে এমন উত্থান-পতন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটিই জীবনের শেষ অধ্যায় নয়। এরপরের অধ্যায় হতে পারে অনেক সুখকর।

"তোমরা মনমরা হয়ো না, হতাশ বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী হবে যদি বিশ্বাসী হও"। (সূরা আলে ইমরান ১৩৯)


"যখন তারা দুজন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ রয়েছেন"। (সূরা আত-তাওবা ৪০)

"নিশ্চয় কষ্টের সাথে সাথে স্বস্তি রয়েছে। অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে"। (সূরা আল-ইনশিরাহ ৫-৬)

যাদের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত বা অশান্তিতে থাকে, তারা প্রশান্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার জিকির করতে পারেন। 

"যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহ্‌র জিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখো, আল্লাহ্‌র জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি পায়"। (সূরা আর-রাদ ২৮)

যাদের অন্তর অস্থির ও বিক্ষিপ্ত থাকে, তারা নামাজে মনোনিবেশ করার অনুশীলন করতে পারেন। নামাজ আমাদের মনোযোগিতা বা মাইন্ডফুলনেসের প্রশিক্ষণ দেয়। এনে দেয় প্রশান্তি। নামাজে মনোযোগ ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক। বারবার মনোযোগ ফিরে পাওয়াই মাইন্ডফুলনেস। রাসুলুল্লাহ সা. বেলাল রা.কে বলতেন, "সালাতের ব্যবস্থা করে আমাকে শান্তি দাও, হে বেলাল"! (আবু দাঊদ ৪৯৮৫) "সালাতেই দান করা হয়েছে আমার চক্ষুর শীতলতা" (মুসনাদে আহমাদ, ১২২৯৩; সুনানে নাসাঈ, ৯৩৪০)।


৭. ধৈর্য হলো একজন শক্তিশালী মনের মানুষের প্রধান গুন। ধৈর্যই মানুষকে সব বিপদ আর দুরাবস্থার মধ্যে আশা করার শক্তি দেয়। যার মাঝে ধৈর্য নেই, ধরে নিতে হবে সে একজন দুর্বল মনের মানুষ, যে অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়ে। একজন মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহস না থাকলে তার মাঝে ধৈর্য থাকে না। একজন মানুষের মাঝে ধৈর্য এর অভাব থাকলে অনুপ্রেরণা আর অনুশীলনের মাধ্যমে সে এই গুণটি অর্জন করতে পারে। ধৈর্য হলো জগতের সবচেয়ে শক্তিমান যোদ্ধা। অসাধারণ কাজগুলো শক্তি নয়, অসীম ধৈর্য দিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। বিশ্বাস আর ধৈর্য একে অপরের হাত ধরে চলে। আপনি যখন সবকিছুর পরও সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখবেন, তখন আপনার জীবনে আনন্দ নেমে আসবে। যখন সৃষ্টি কর্তার ওপর আপনার বিশ্বাস থাকবে, আপনি অনেক বেশি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন। 'হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাযের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে আছেন' (বাকারা ১৫১)। "যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোন নি‘আমত কাউকে দেয়া হয়নি" (বুখারি, ১৪৬৯)। 

সর্বাবস্থায় সার্বক্ষণিক সবর মানে কোন কিছু ভালো-মন্দ, পক্ষে-বিপক্ষে যাই হোক পরিস্থিতির আলোকে মেনে নেয়া বা গ্রহণ করা (accept)। এতে করে মানসিক চাপ কমে এবং দ্বন্দ্ব নিরসন (conflict resolution) হয়। ফলে রূপান্তরজনিত মনোবৈকল্য (conversion & dissociation) প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সবরের প্রশিক্ষণ বিশেষ কাজে লাগতে পারে। এছাড়া সাইকোথেরাপিতে Restoration of morale তৈরিতে সবরের গুণ ভূমিকা রাখতে পারে।


৮. ব্যক্তিত্বের বিকৃতি (personality disorder) মানসিক রোগসমূহের আরোগ্য সম্ভাবনা (prognosis) বিনষ্ট করে। ব্যক্তিত্বের বিকৃতি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চরমভাবে ভোগাতে পারে। বিশেষ করে antisocial, borderline, narcissistic ব্যক্তিত্বগুলো। কুর'আন মানুষের খুব সুন্দর ও সার্বজনীন ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য উদাহরণ তুলে ধরেছে। রহমানের প্রকৃত ও প্রিয় বান্দাদের ১৩টি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এক. তারা আল্লাহর প্রকৃত (প্রিয়) বান্দা।

দুই. জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে। তারা অহংকারী ও দাম্ভিক নয়।

তিন. মূর্খলোকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ‘সালাম’ তথা (শান্তিপূর্ণ কথা) বলে এড়িয়ে যায়।

চার. রাত যাপন করে তাদের রবের সামনে সিজদাবনত হয়ে এবং দণ্ডায়মান অবস্থায়। অর্থাৎ রাত জাগরণ করে ইবাদতের ভেতর দিয়ে রাত কাটায়।

পাঁচ. আল্লাহর ভয় ও  পরকালের চিন্তায় ইবাদতে মশগুল থাকে এবং আল্লাহর কাছে পানাহ চায়।

ছয়. অপব্যয় করে না এবং কৃপণতা ও ত্রুটিও করে না; বরং উভয়ের মধ্যবর্তী সমতা বজায় রাখে।

সাত. ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না। কেননা, শিরক সর্ববৃহৎ গুনাহ। আল্লাহ সব কিছু ক্ষমা করলেও শিরক ক্ষমা করবেন না।

আট. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না।

নয়. ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না।

দশ. মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে যোগদান করে না। মিথ্যা চর্চাকেন্দ্র এবং অনর্থক আলোচনার আসর থেকেও আল্লাহর প্রিয় বান্দারা বিরত থাকেন।

এগারো. কোনো অন্যায় বা বেহুদা কার্যকলাপের কাছে দিয়ে অতিক্রম করলে আত্মসম্মান বাঁচিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে ভদ্রতার সঙ্গে চলে যায়।

বারো. তাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করানো হলে, তখন তারা এসবের প্রতি অন্ধ ও বধিরদের মতো আচরণ করে না, বরং শ্রবণশক্তি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের মতো এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং তদনুযায়ী আমল করে।

তেরো. নিজ সন্তানসন্ততি ও স্ত্রীদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করে, হে মাবুদ, তাদের আমাদের চক্ষু শীতলের উপকরণ বানাও।

ব্যক্তিত্বের এই গুণগুলো সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনে সূরা ইসরা, আনকাবুত ও বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। 

৯. মাদকের ব্যাপারে ইসলাম জিরো ডিগ্রি টলারেন্স ঘোষণা করেছে। যা কিছু নেশাগ্রস্ত করে বা মস্তিষ্কের সামান্য বিকৃতি ঘটায় সেসবই মাদক ও হারাম। ৪ ধাপে মাদক নিষিদ্ধের ঘোষণা করা হয়েছে। যা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও বৈজ্ঞানিক পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। তাই মাদকাসক্তি থেকে রক্ষা পেতে ক্রমাগত পরিমাণ কমিয়ে (harm reduction) ধীরেধীরে বন্ধ করে দেয়ার চিকিৎসা বেশ কার্যকরী। 


হাফিজ ইবনুল কাইয়্যিম জানাচ্ছেন, "আপনাদের জানা উচিত যেকোন ঐচ্ছিক কাজের মূলে রয়েছে খাওয়াতির ও ওয়াসবিস। খাওয়াতির ও ওয়াসবিস মানুষের সজ্ঞান চিন্তায় পরিণত হয়, চিন্তাটি স্মৃতি হিসেবে রক্ষিত হয় অথবা সামনে ধাবিত হয়। স্মৃতি তখন বিষয়টিকে স্বাধীন ইচ্ছা, প্রেষণা, উদ্যম, কামনা বা সংকল্পে রূপ দেয়। পরিশেষে তা বাস্তব জীবনে কর্মে পরিণত হয়। কর্মের পুনরাবৃত্তি তা অভ্যাসে পরিণত করে। সুতরাং কোন নেতিবাচক অভ্যাস শক্তি অর্জন করার পূর্বেই প্রাথমিক পর্যায়ে তা বর্জন করা সহজ"। খাওয়াতির শব্দটি খাতিরাহ শব্দের বহুবচন যার অর্থ অন্তর্গত চিন্তা, গোপন ইচ্ছা বা মনে মনে আত্মকথন যা দ্রুত ও ক্ষণকালের জন্য মনে উদয় হয়। একে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় inner thought, impulse, urge, monologue বলা হয়। আবার একে বিজ্ঞানী বেকের ভাষায় অটোমেটিক থটও বলে। ওয়াসবিস শব্দটি ওয়াসওয়াসার বহুবচন যার ব্যাপারে বলা হয়েছে, শয়তান মানুষের বুকে  ক্রমাগত কুমন্ত্রণা দেয়। মজার ব্যাপার, আধুনিক মনোবিজ্ঞান এই মেকানিজমের সাথে পুরোপুরি একমত। যেকোন আসক্তি (মাদক, জুয়া, পর্ন, ইন্টারনেট ইত্যাদি) এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়। আবার আসক্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য যে সাইকোথেরাপি ডিজাইন করা হয় সেটিরও প্রধান লক্ষ্য থাকে অবচেতন বা নির্জ্ঞান মনের এই চিন্তা থেকে কর্মে পরিণত হওয়ার শেকলকে ভেঙে দেয়া। 


১০. আত্মহত্যার কোন সুযোগ ইসলাম রাখেনি। আত্মহত্যাও (suicide) নয়, নরহত্যাও (homicide) নয়। আত্মহত্যার অনেকগুলো প্রটেক্টিভ ফ্যাক্টর রয়েছে। ধর্ম এরকম একটি রক্ষাকবচ হতে পারে। "আর তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে অন্যায়ভাবে আত্মহত্যা করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য” (নিসা, ২৯-৩০)।


১.৪ শেষ কথা

মনোরোগের বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা প্রচলিত আছে। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Bio-psycho-social এপ্রোচ। এটি একটি সমন্বিত প্রয়াস। নববি চিকিৎসায় আমরা যা কিছু আলোচনা করলাম তার অধিকাংশই psychosocial এপ্রোচের আওতাধীন। Biological ট্রিটমেন্ট হল বিভিন্ন ধরণের ঔষধ। সুতরাং ঔষধকে বাদ দিয়ে শুধু কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি রোগ উপশমের জন্য যথেষ্ট না। রোগের জন্য যুগোপযোগী চিকিৎসা নেয়া, ঔষধ খাওয়া বা অন্যান্য ফিজিক্যাল ট্রিটমেন্ট নেয়াটাও সুন্নাহ'র অংশ। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন (APA) মনে করে, মনোরোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় কালচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বলা বাহুল্য, ধর্ম কালচারের মৌলিক ৬ টি উপাদানের একটি। বিশ্বাস (faith) মানুষের চিন্তাপদ্ধতিকে (cognitive process) প্রভাবিত করে, আলোড়িত করে। আচরণ ও ব্যক্তিত্বকে কাঠামো প্রদান করে। লাইফস্টাইলকে প্রতিফলিত করে। মনোরোগের নববি চিকিৎসা হিসেবে বর্ণিত টেকনিকসগুলো মূলত প্রতিরোধমূলক ও নিউরোটিক রোগের উপশম। মানসিক সুস্বাস্থ্য ও প্রোডাক্টিভিটির জন্য উপকারি তা সফলভাবে প্রমাণিত। 


No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.